‘৭১-এর ক্রান্তিকাল কাটিয়ে উঠার পর আমাদের শিক্ষাকালীন সময় ও এর পূর্ব থেকে কুণ্ডেশ্বরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্যান্য অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি কীর্তিমান প্রতিষ্ঠাতা শহীদ অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে বছরে দু’বার বেশ আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো, যা এখনও বিদ্যমান। যুগ পুরুষ নূতন চন্দ্র সিংহের সুযোগ্য পুত্র সকলের প্রিয় মন্টু স্যারের (প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ) সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিশাল এই অনুষ্ঠান পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর পদচারণা ধন্য এই কুন্ডেশ্বরী ভূমিতে প্রতিবছর দেশবরেণ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি, শিক্ষাবৃত্তি প্রদান ও ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পর্বে সাজানো হতো অনুষ্ঠানগুলো। পহেলা ডিসেম্বর ২০১৬, শাশ্বত বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারীশিক্ষা চেতনাবাদের অগ্রদূত অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের জন্মদিন অনুষ্ঠানে আমাদের মঙ্গলময় যাত্রা। মনোরমা আবাসিক ছাত্রী নিবাসের তত্ত্বাবধায়িকা শাহানা আপার সাথে আন্তরিক যোগাযোগ স্থাপনের ফলস্বরূপ দীর্ঘ ২২ বছর পর (আমাদের বিদায়ের দিন হতে) বিদ্যালয় পানে যাওয়ার শুভসূচনা তৈরি হয়েছিলো। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে বাড়তি খাবার পরিবেশনের রেওয়াজ ছিল। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি, মনোরমা হলের ছাত্রীদের সাথে আমাদের দুপুরের আহার পর্বে যোগদানের ব্যবস্থা হয়েছিলো।
এবার সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত! নিমন্ত্রিত অতিথিদের দুপুরের ভোজন শেষে স্যার মঞ্চের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, ক্লান্তিহীন ব্যস্ততা, তবুও স্থির লক্ষ্যভেদে আমাদের দেখতেই স্যারের মায়া ভরা কণ্ঠ – ‘ তোরা এসেছিস এতো বছর পর আমার মেয়েরা ‘। স্যারের চোখের সারল্যে, হাসিমাখা মুখাবয়বে তাকালেই বোঝা যেতো প্রাক্তন ছাত্রীদের আগমনে তিনি কতটা আনন্দিত হতেন। সেদিন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির পদ অলংকৃত করেছিলেন ইউজিসি চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান। মঞ্চে ছিলেন আরও কয়েক সম্মানিত ব্যক্তি। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় শিল্পী কুমার বিশ্বজিত ও কুন্ডেশ্বরী পরিবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী চন্দন সিনহা জ্বলে উঠেছিলেন তারার বেশে। নাচে গানে মুখরিত স্যারের সাথে কাটানো দিনটি স্মৃতিপটে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এরপর ২০১৭- তে রি-ইউনিয়ন বিষয়ে স্যারের সাথে আমাদের ব্যাচের নাজমা ও কান্তা ঢাকায় দেখা করেন। পরবর্তীতে কুন্ডেশ্বরীতে গিয়ে স্যারকে দেখার উদ্দেশ্য ও রি-ইউনিয়ন সম্পর্কিত আলাপচারিতায় আরও অনেক কথা উঠে আসতো। ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্মরণীয় নানা প্রসংগে স্যার বলতেন, আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম সেইসব অজানা তথ্য। এতো সুন্দর করে বলতে পারতেন তিনি। স্যারের স্মরণশক্তির প্রখরতা দেখে মুগ্ধ হতাম আমি। সৌভাগ্যক্রমে আমরা সেদিন আমেরিকা প্রবাসী স্যারের জ্যেষ্ঠ কন্যা রাখি দি সহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে কাছে পেয়েছিলাম।
২০২০ সাল ৬ই মার্চ স্যারের সাথে শেষ দেখা। বিগত কয়েক বছরে স্যার কিডনি রোগে ভুগছিলেন, যা ডায়ালাইসিস পর্যায়ে চলে যায়। দিনে দিনে স্যারের শরীর খারাপ হতে শুরু করে। কয়েক দফায় দেশের বাইরেও স্যার চিকিৎসা নিয়েছিলেন। এমন অসুস্থ শরীরে আমরা এসেছি শুনে স্যার দেখা করতে আসেন আমাদের সাথে। দেহে অনেকটা দুর্বলতার গ্রাস, কিন্তু উনার মনোবল ও স্মৃতিশক্তি তখনো বেশ ভালো। একটি বারের জন্য মনে আসেনি স্যারের সাথে এটাই শেষ দেখা হবে, বা স্যার আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে যাবেন। হ্যাঁ, সংগ্রামী, লড়াকু, মুক্তিযোদ্ধা আমাদের স্যার কঠিন অসুখের সাথে লড়াই করেই বেঁচে ছিলেন। আরও বাঁচতেন তিনি। এমন মানুষ একদিনও যদি বেশি বাঁচেন, সেটা আমদের জন্য অনেক সৌভাগ্য পূর্ণ হতো। একদিন সবাইকে যেতে হবে, স্যার-ও চলে গেলেন। পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে পরপারে চলে যাওয়া আমাদের স্যার স্বমহিমায় চির অমর চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন আমাদের অন্তরাত্মায়।