বৃহত্তর চট্টগ্রামে চলতি বছর ৫ মাসে ২৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে চারজনের বেশি খুন হয়েছেন। ভাগ্যজোরে বেঁচে গিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছেন আরো তিনজন। সর্বশেষ গত বুধবার টেকনাফে ছোট ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে খুন হন তিনজন। পারিবারিক কলহ, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, পূর্ব শত্রুতা, আর্থিক যোগসূত্র এবং বিকৃত মানসিকতা–এ পাঁচটি কারণে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, পারিবারিক কলহ, মাদক, যৌতুক, পরকীয়া, প্রেম, দাম্পত্য সমস্যা, জমি–জমা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করেই অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটছে। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে শিশুও। এ সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পরিবারিক বন্ধন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতার কারণে জীবনে বাড়ছে হতাশা, মানসিক বিষণ্নতা, আর্থিক দৈন্য। ফলে সমাজে বেড়ে চলছে অপরাধ।
সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন আজাদীকে বলেন, সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া, অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই ঘটছে এসব খুনের ঘটনা। দিনে দিনে পাল্টাচ্ছে খুনের ধরনও। দিন দিন মানুষ আরো বেশি পাশবিক হয়ে উঠছে। সম্পর্ক জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক ঐতিহ্য পরিবার থেকে সরে যাচ্ছে। নতুন নতুন বিষয় যোগ হচ্ছে। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা কমছে। এ অবক্ষয় রোধ করতে পারিবারিক বন্ধন বাড়ানোর পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ কঠোর হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার একেএম মহিউদ্দিন সেলিম আজাদীকে বলেন, খুনের যত ঘটনা ঘটছে এর কিছু রাজনৈতিক আর কিছু সামাজিক অস্থিরতা থেকে হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কখন কাকে কে ছুরি মারছে এটা আগে থেকে বোঝা মুশকিল। আর সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কারো নেই।
তিনি বলেন, সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার কারণে নৃশংস হয়ে উঠছে মানুষ। যে কারণে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে। পুলিশ প্রতিটি খুনের ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে খুনিদের গ্রেপ্তারে সচেষ্ট রয়েছে। চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি খুনের ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
২৫ মে পেকুয়ায় কোহিনূর বেগম (৪২) নামে এক গৃহবধূকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে দেবর আলী আহমেদের বিরুদ্ধে। বিকাল ৩টায় উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের মাতবর পাড়ায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত কোহিনুর বেগম প্রবাসী আমির হোসেনের স্ত্রী।
কঙবাজারের টেকনাফে অপহরণের ২৫ দিন পর ২৪ মে পাহাড়ে মিলে তিন বন্ধুর মরদেহ। ছোট ভাইয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন তারা। তাদের অপহরণ করার পর মুক্তিপণ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল এক লাখ টাকা। তবুও ছেড়ে দেয়নি।
একই দিন সীতাকুণ্ডে এক গৃহবধূকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করার পর গৃহবধূ রোকসানা বেগম শারমিনকে (১৭) আগুনে পোড়ানোরও চেষ্টা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। ২৪ মে বিকেলে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের রহমতপাড়া এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি স্থানীয় আনোয়ার কিবরিয়ার স্ত্রী। ১০ মাস আগে তাদের বিয়ে হয়।
১৭ মে আনোয়ারায় কলাগাছের পাতা কাটাকে কেন্দ্র করে চাচাতো ভাইয়ের হাতে বোন খুন হয়েছে। ১২ মে সীতাকুণ্ডের বিআইটিআইডি হাসপাতালে সীমানা দেয়ালের ভেতরের একটি ডোবা থেকে অজ্ঞাত পরিচয় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, হত্যার পর ওই তরুণীকে ডোবায় পুঁতে ফেলা হয়েছে।
৮ মে পাহাড়তলী থানায় কিশোর গ্যাং গ্রুপের দুই পক্ষের সংঘর্ষে দুজন নিহত হয় এবং তিনজন আহত হয়। ওইদিন বাঁশখালীতে পূর্বশত্রুতার জের ধরে র্যাবের সোর্স সন্দেহে হামিদ উল্লাহ (৩৫) নামে এক কৃষককে জবাই করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। উপজেলার সরল ইউনিয়নের দক্ষিণ সরলের হাজিরখীল গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন তার স্ত্রী মরতুজা বেগম (২৮)। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, ২০১৯ সালে ক্রসফায়ারে নিহত ডাকাত জাফর আহমদ প্রকাশ জাফর মেম্বার ও ডাকাত মো. খলিলের ছেলেরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
৩০ এপ্রিল পটিয়া উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়ন শেখ মোহাম্মদ পাড়ায় জেরিন আক্তার (২২) নামে এক গৃহবধূকে যৌতুকের জন্য খুন করা হয়েছে। এজন্য তিনজনকে আসামি করে পটিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন নিহতের পরিবার।
২৯ এপ্রিল চট্টগ্রামে আতশবাজির প্রলোভন দেখিয়ে সফিউল ইসলাম রহিম নামে (১১) এক শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করেছে প্রতিবেশী মো. আযম খান ও তার বন্ধু হৃদয়। ২৫ এপ্রিল কর্ণফুলী উপজেলায় জমির সীমানা প্রাচীর নির্মাণ নিয়ে বিরোধের জেরে মা ও ছেলেকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছেন প্রতিপক্ষের লোকজন। এ ঘটনায় নিহতের আরো দুই ছেলে আহত হয়েছেন।
২৫ এপ্রিল নগরীর বন্দর থানার কলসী দিঘি সড়কের ওয়াশিল চৌধুরী পাড়ায় একটি ভবনের তৃতীয় তলার একটি বাসার দরজার তালা ভেঙে রীনা নামে এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা জানান, তাকে খুন করে স্বামী সাখাওয়াত বাসায় তালা দিয়ে পালিয়ে গেছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি বন্দর কলোনির কুয়ার পাড় এলাকায় ১১ নম্বর বিল্ডিংয়ের সামনের খালি জায়গায় অবৈধভাবে নির্মাণ করা একটি টিনশেড ঘরের তালা ভেঙে সালাউদ্দিন নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি জেলা শহরের বনরূপায় ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন ইজাজুল হক রাব্বি (৩৫) নামে এক যুবক।
১৫ ফেব্রুয়ারি স্ত্রী–সন্তান নিয়ে কঙবাজারের কলাতলীর হোটেল সি আলিফের চতুর্থ তলার ৪১১ নম্বর কক্ষে এক নারী ও তার শিশু সন্তান খুন হন। কঙবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, জেবিন দেব পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে কঙবাজারে এনে হোটেল কক্ষে পরিকল্পিতভাবে খুন করেছেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি কঙবাজারে সি–বার্ড নামে একটি হোটেলে খুন হন ২৭ বছর বয়সী এক নারী। হোটেলের এন্ট্রি তালিকা অনুযায়ী তার নাম জেসমিন আক্তার। হত্যাকাণ্ডের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমানকে (৫১) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর পতেঙ্গা থানা এলাকায় দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে ছুরিকাঘাতে এক তেল ব্যবসায়ী খুন হন। স্থানীয় সন্ত্রাসী ইলিয়াস ওরফে গাভী ইলিয়াসের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা পুলিশ ও স্থানীয়দের। ২১ জানুয়ারি কর্ণফুলী উপজেলার সিডিএ আবাসিক এলাকায় রাস্তার পাশ থেকে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মোহাম্মদ কায়েস (৩৩) নামে ওই যুবক পুলিশের সোর্স। কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল মাহমুদ জানান, মাদক ব্যবসায়ীর কাছে পরিচয় জানিয়ে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের ওই সোর্সকে খুন করেছে আরেক সোর্স।
২১ জানুয়ারি বাঁশখালী উপজেলায় জঙ্গলের ভেতর নিয়ে হাত–পা কেটে বীভৎসভাবে স্ত্রীকে খুনের চেষ্টা করে তার স্বামী ইয়াকুব। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামে পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করে রাবেয়া আক্তার নামে এক নারীকে গলা কেটে হত্যা করেছে স্বামী। ১১ জানুয়ারি বাঁশখালীর গন্ডামারা ব্রিজ এলাকায় ছিনতাইকারীদের হাতে একটি বেসরকারি কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি দুদু মিয়া ছুরিকাঘাতে খুনের শিকার হয়েছে।