যুগ যুগ ধরে আদিবাসী মানুষ তাঁদের ঐতিহ্যগত জীবনাচার দিয়ে পরিবেশের কল্যাণ করে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামগ্রিক প্রাকৃতিক নাজুক অবস্থায় বিজ্ঞানীরা প্রতিটা ক্ষেত্রে টেকসই, দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার কথা বলে আসছেন বহুদিন ধরে যা এখনো সুদূর পরাহত এবং জীবের সামগ্রিক অস্তিত্ব সংকটময় সেখানে বিশ্বের প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন আদিবাসী তাঁদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রকৃতিঘনিষ্ঠ জীবনযাত্রা দিয়ে এই টেকসই, কার্বনশূন্য জীবন পৃথিবীকে উপহার দিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে জীবন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে সে জীবনের সাথে আদিবাসীদের নিবিড় সম্পর্ক।
আদিবাসীদের জীবনব্যবস্থায় নারী বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আদিবাসী সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা এবং এবং তাঁদের কর্মবিন্যাসে নারীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ঐতিহ্যগত প্রকৃতি নির্ভর যে-জীবন ব্যবস্থা তাতে নারীরা বিশেষভাবে যুক্ত। তাঁদের নখদর্পণে থাকে প্রকৃতিশিক্ষা। প্রকৃতির গায়ে গায়ে রয়েছে জীবনধারণের সমস্ত আয়োজন। সেই শিক্ষা বংশ পরম্পরায় ছড়িয়ে দেয়ার মূল কাজটা করে আদিবাসী নারীরা। বনজঙ্গলে, পাহাড়ে, ঝর্ণায়, ঝিরিতে ছড়িয়ে থাকে; লুকিয়ে থাকে জীবন উপকরণ। যত্নের সাথে রক্ষা করে তাদের ব্যবহার করার পদ্ধতি জানা কেবল এই প্রকৃতি নির্ভর মানুষগুলোর কারণ প্রকৃতিকে তারা মায়ের মত জানে। তাদের ধর্মাচার আবর্তিত এই প্রাণ-প্রকৃতিকে কেন্দ্র করেই।
জলবায়ু আন্দোলনে তাই আদিবাসীরা বিশেষ করে আদিবাসী নারীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি শিকার তারা। প্রকৃতিতে যে বিশাল পরিবর্তন তা টেরও পাচ্ছে সর্বপ্রথম তারা কারণ তারা খুব ভালো করে জানে প্রকৃতির গতিপ্রকৃতি। এর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পরিবর্তনও তাদের অগোচর নয়। অ্যামাজনের আদিবাসীরা বহু আগে থেকে এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। পৃথিবীর ফুসফুস অ্যামাজনে মুনাফালোভী দস্যুদের দৌরাত্ম্যে উজাড় হয়েছে এবং হয়েই যাচ্ছে একরের পর একর বনভূমি। স্বয়ং রাষ্ট্র এর সাথে জড়িত। অবৈধ কাঠপাচারকারীদের বিরুদ্ধে আদিবাসী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বহু বছর। অনেক পরিবেশকর্মী প্রাণ দিয়েছে কিন্তু বন কাটা থামেনি। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নারীরা জলবায়ু আন্দোলনে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও আদিবাসীরা প্রকৃতি রক্ষায় এখন পর্যন্ত বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। এদেশে প্রায় ৪৫টির মতো আদিবাসী গোষ্ঠী আছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসীর বাস। এই আদিবাসীদের জীবন বেশীরভাগেরই প্রকৃতিনির্ভর। যদিও এখন পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। প্রকৃতি আক্রান্ত হওয়ায়, জলবায়ু এবং মনুষ্য সৃষ্ট প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞে তারা প্রকৃতির সাথে টিকে থাকার লড়াইয়ে পরাস্ত হচ্ছে। বাধ্য হচ্ছে বহু দিন থেকে চলে আসা প্রকৃতিনির্ভর জীবন থেকে সরে আসতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবাই কারণ প্রাণ-প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার যে কৌশল তা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে। ভঙ্গুর জীবনব্যবস্থা থেকে ফেরার পথগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
জুম চাষপদ্ধতি যেমন পাল্টে গেছে জীবনের জন্য, প্রাণ-প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর বিষ এখন জুমেও ব্যবহার হচ্ছে। গাছ নিধন, পাথর উত্তোলনের ফলে ঝিরির পানি শুকিয়ে গেছে। আগ্রাসী, অচেনা গাছে পাহাড়ের মাটি ঝুরঝুরে হয়ে পড়েছে, অন্য এলাকার ফলের বাগান করার ফলে কীটনাশক এবং সারের ব্যবহার বেড়েছে এবং মাটিতে বিষের উপস্থিতি বাড়ছে। পাহাড় হারাচ্ছে প্রাণ বৈচিত্র্য্য। আদিবাসীদের যে প্রকৃত জীবনাচার তা থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে তাঁরা এবং জলবায়ু সমস্যার সাথে যুক্ত হচ্ছে প্রাণ-বৈচিত্র্য হারানো জটিল এক প্রক্রিয়া। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এসব সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসাটা এখন অত্যন্ত জরুরী। আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিশেষ করে আদিবাসী নারীদের প্রকৃতির সাথে সহবস্থানের যে জ্ঞান তা’ অমূল্য, সে সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-জ্ঞান-প্রজ্ঞা রক্ষায় সকলেই এগিয়ে আসুক।