জগতের বিচিত্রলোকে পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর অস্তিত্ব প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। পৃথিবীর প্রকৃতি অপূর্ব সৌন্দর্যময় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। অকৃপণ এই সবুজ সুশীতল প্রকৃতির মধ্যে জীব বৈচিত্র্যে অপরূপ রূপে একাকার হয়ে মিলেমিশে প্রাকৃতিক শোভাবর্ধন করে। ঠিক যেন প্রাণির বসবাসযোগ্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। শ্যামল মাটি, আলো-বাতাস, আবহাওয়া, ঋতুবৈচিত্র্য, প্রকৃতির অপরূপ রূপ, সবুজের সমারোহ, বন-বনানি, ফুল-ফলাদি, বৃক্ষ, তরু-লতা, নদী-নালা-খাল-বিল, পুকুর, পাহাড়-পর্বত, সাগর, নীল আকাশ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রভৃতির কাছে আমরা আমৃত্যু ঋণী। মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হয়ে মাটিতে জীবন আবার মাটিতে মরণ তাই এ শ্যামল মাটির ঘ্রাণকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা চিরন্তন। এই প্রকৃতিই মানুষের আদি শিক্ষক। শ্যামল মাটি, পানি, তাপ, বাতাস যা প্রাণির বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদান। সূর্যের কিরণ পৃথিবীকে উত্তাপ দিয়ে থাকে, নদীর প্রবাহ একদিকে পলিমাটির যোগান দেয় অন্যদিকে মিঠা পানির সরবরাহ করে আর সবুজ গাছপালা বন-বনানি, লতা-পাতা সমগ্র বৃক্ষাদি মানবজাতিসহ প্রাণিকুলকে বেঁচে থাকার অঙিজেন দান করে থাকে অকাতরে বিনিময় ছাড়া। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সারা জীবন প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। প্রকৃতির এ দান কোনভাবে শোধ করা সম্ভব নয় একমাত্র পরিবেশকে আপন মমতায় যত্ন করে আশেপাশে সবুজ বনায়ন করলে বিশুদ্ধ বাতাসে মানব শরীরের ফুসফুসকে সতেজ রাখা যায় সহজে। তাই এ সবুজে বেষ্টিত অপরূপ প্রকৃতিই হয়ে উঠবে পৃথিবীর ফুসফুস। চেষ্টা করবো এ রকম এক পৃথিবীর ফুসফুসকে আপনাদের কাছে উপস্থাপনা করার। সত্যি বলতে কি, প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে গিয়ে নতুন নতুন তথ্যে সমৃদ্ধ হচ্ছি যা প্রকৃতির অকৃপণ দান আমায় অভিভূত করে ,স্বপ্ন দেখায় প্রকৃতি রক্ষায়।
এই মহাপৃথিবীর বুকে আমাজান রেইনফরেস্ট দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান নদী বিধৌত অঞ্চলে অবস্থিত বিশাল বনভূমি। ৭০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার অববাহিকা পরিবেষ্টিত এই অরণ্যের প্রায় ৫৫ লক্ষ কিলোমিটার এলাকাটি মূলত আর্দ্র জলবায়ু দ্ধারা প্রভাবিত। ৯টি দেশ জুড়ে এই রেইন ফরেস্ট বিস্তৃতি। ৬০% রয়েছে ব্রাজিলে, ১৩% রয়েছে পেরুতে এবং বাকী অংশ রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানা। পৃথিবীর যত রেইনফরেস্ট আছে তার অর্ধেকটাই আমাজান। পৃথিবীর ২০% অঙিজেন সৃষ্টি হয় আমাজান থেকে তাই আমাজান রেইনফরেস্টকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। আমাজান পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তমাশ্চ্যর্যের একটি। এই বনের আমাজান নদী বেশির ভাগ নদীর উৎস। গবেষণায় বলছে নিউইয়র্ক শহরে ১২ বছরে যত পানি ব্যবহৃত হয় আমাজান নদীতে তার চেয়েও বেশি পানি প্রবাহিত হয় একদিনে। গোটা পৃথিবীর পরিচ্ছন্ন পানির ২০ ভাগ বয়ে চলে এই নদীতে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদী নীলনদকে বললেও এক জরিপে প্রমান হয় নীলনদের চেয়ে আমাজান নদী ১০৫ কিলোমিটার বড়। এ ছাড়া আয়তনের দিক থেকে আমাজান সবচেয়ে বড়। প্রতি সেকেন্ডে ৫৫ মিলিয়ন গ্যালন পানি আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবাহিত করে এই নদী। এখানে উল্লেখ যে, আমাজান নদী এক সময় প্রবাহিত হতো প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে। এর গতিমুখ বদলে আশ্চর্যজনকভাবে প্রবাহিত হয় আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে। এখানকার অত্যাধিক আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত এবং গরম আবহাওয়ার কারণে একে রেইনফরেস্ট বলা হয়। প্রচণ্ড গরমের কারণে এখানে বাষ্পীয়ভবনের হার অনেক বেশি। যা আদ্রতা এবং বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। আমাজান জঙ্গল গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঘন গাছপালা ও পাতায় আবৃত থাকায় সূযের্র আলোর মাত্র ১ শতাংশ পৌঁছায়। এছাড়া বৃষ্টির পানি জঙ্গলের মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে ১০ মিনিট সময় লাগে। এছাড়া আমাজনে আছে ১২০ ফুট উঁচু গাছ, ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ২.৫ মিলিয়ন প্রজাতির কীট-পতঙ্গ, ১২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ হাজারো প্রজাতির অজানা অনুজীব। মাছের মধ্যে আছে মাংসাশী লাল পিরানহা ও পিরারুকু। যার ওজন ১৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে জাগুয়ার ও গোলাপি ডলফিনও বাস করে। বিশ্বের খাবারের যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তার ৮০ শতাংশই আসে আমাজান জঙ্গল থেকে। এছাড়াও বর্তমান যেসব ওষুধ তৈরী হয় তার প্রায় ২৫ শতাংশ উপাদান আসে আমাজান থেকে। আমাজানে আছে ৩০০০ প্রকারের ফল। তবে খাওয়া যায় মাত্র ২০০শ প্রকারের। এই বিরাট ফলের বাগান বিকশিত হয়েছে ৩০০০ বছর আগে। এ বনে ৩০০শ এর বেশি উপজাতি বাস করে। মোট ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। এদের নিজস্ব ভাষা ও আচার-আচরণ স্বতন্ত্র। ৫৫ লক্ষ কিলোমিটার বিস্তৃত এই বনের গহিনে আদিবাসীদের সাথে সভ্য জগতে কোন সম্পর্ক নেই। তারা এখনো আদিম বন্য মানুষের মত দিন যাপন করে। এই রেইনফরেস্টটি যদি কোন দেশ হতো তাহলে আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের নবম দেশ হতো। আরেকটু স্পষ্ট করে বলা যায়, ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডকে যোগ করলে যা হবে তার ১৭ গুন বড় এই আমাজান রেইনফরেস্ট। আমাজান নদীর মুখ এতই বিশাল যে তা এর নিকটবর্তী দ্বীপ মাজারিও কে ডুবিয়ে দেয়। মাজারিও এর আকৃতি সুইজারল্যান্ডের সমান। সাহারা মরুভূমি থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে প্রতি বছর ৪০ মিলিয়ন টন বালি উড়ে আসে আমাজানে। ফলে সহজে জীববৈচিত্র্য টিকে আমাজানে। এখানকার প্রাণি ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যময় এবং অসংখ্য প্রজাতির এক কথায় বিচিত্র প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ। আমাজান বন অত্যন্ত দুর্গম হলেও প্রাচীনকালে অভিযাত্রীরা এ বনে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ধন রত্নের খোঁজে প্রবেশ করতো। রহস্য ঘেরা এ বনে পর্তুগীজ অভিযাত্রীদের বিশ্বাস ‘এলডোরাডা’ নামে একটি গুপ্ত শহর আছে সেই শহরটি পুরোটা স্বর্ণের। আজো সেই শহরের খোঁজ মিলেনি শুধু রয়ে গেল মানুষের মধ্যে অদ্ভুত রহস্যই। আবার আমাজনের নামের আছে এক গল্প। স্প্যানিশ এঙপ্লোরার ফ্রান্সিস্কো অরেল্লানাকা আক্রমণ করেন এক নারী যোদ্ধা। ফ্রান্সিস্কো সেই নারী যোদ্ধার নাম রাখেন আমাজান – গ্রীক পুরাণের আমাজনের নামে। সেখান থেকেই কালক্রমে বন ও নদীর নাম হয় আমাজান। সর্বদিক থেকে এ বন এখনো পদচারণা থেকে বহুদূরে। দুর্গম সংবাদ সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ করা, ছবি তোলা হয় হেলিকপ্টারের সাহায্যে। এখানকার ইকোসিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী। যা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে টিকে আছে আর মানব সভ্যতাকে অকাতরে অঙিজেন দান করে ফুসফুসের কাজটা প্রকৃতিগতভাবে করে যাচ্ছে এই বিশালাকার আমাজান রেইনফরেস্ট। যা বরাবর মনে হয় বড় বিস্ময়কর ও গভীর চিন্ত্যনীয়। তাই কবিতার ছন্দে বলি:
‘সবুজ মাঠ সবুজ ঘাস সবুজে সবুজে একাকার
মুগ্ধতার আহ্বানে এদিক ওদিক ফিরে তাকাই বারবার।’
উপরের অপরূপ সৌন্দর্যসহ হাজারো হাজারো প্রকৃতির অপরূপ রূপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমগ্র বিশ্বময়। এ প্রকৃতিকে ভালোবেসে যত্ন করতে হবে সুস্থভাবে বাঁচার জন্য। বর্তমানে প্রায় আটশত কোটি মানুষ পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন প্রান্তে মহানন্দে বসবাস করছে। আর মাত্র তিন দশক পরে ২০৫০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে এক হাজার কোটিতে। এ পরিবেশকে সংরক্ষণ করা একমাত্র দায়িত্ব আমাদেরই। মানব সভ্যতার আধুনিকায়ন, বিজ্ঞান নির্ভর জীবন ও নগরায়ণের নাগরিক সুবিধা বাড়াতে গিয়ে অকারণে গাছপালা ধ্বংস করা, পাহাড় কাটা, খাল-নদী ভরাট করা, পরিকল্পনাবিহীন বিভিন্ন স্থাপনা তৈরী করা, কলকারখানার দূষিত ধোঁয়া ও বর্জ্য, জাহাজ কাটা এমন কি ইটের ভাটা সর্বোপরি গাড়ির নির্গত কালো ধোঁয়া পরিবেশকে ভয়াবহ করে তুলেছে। পানি, বায়ু, মাটি ও শব্দ দূষনের প্রকটতা বেড়েই চলছে সর্বত্র। প্রকৃতিকে নিঃস্ব করে, বনসম্পদ উজাড় করে তার প্রাণসম্পদ হরণ করে পৃথিবীকে দিনদিন বাস অযোগ্য করে তুলছি। তাই আজ প্রকৃতিতে নেমে এসেছে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ এর মতো কঠিন প্রাদুর্ভাব। এ কঠিন সময়ে অকালে অকাতরে ঝড়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় স্বজনরা। বহু প্রাণ চলে গেল বড় অসময়ে নীরবে-নিভৃতে। দুঃখ, বেদনা আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আহ্বান করি সকলের কাছে, আসুন প্রকৃতিকে নিজের প্রানের মত ভালোবাসি। খাদ্য গ্রহণ না করলে কয়েকদিন বাঁচা যায়, পানির অভাবেও থাকা যায় কিন্তু বাতাসের অভাবে এক মুহূর্তেও বাঁচতে পারি না – ‘প্রাণবায়ু উড়ে যায় নিমিষেই’। তারই প্রমান হলো করোনাকালে। হায়! একটু অঙিজেনের জন্য চারিদিকে নির্মম আত্মচিৎকার , হাহাকার ও ক্রন্দনে বারবার মনপ্রাণ কেঁদেছে কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারিনি। আমরা মানবজাতি এ দৃশ্য আর দেখতে চায় না। তাই সকলে মিলে মিশে এ প্রকৃতিকেই ভালোবেসে মানব শরীরের ফুসফুস কে রক্ষা করি পৃথিবীর ফুসফুসকে সেবা আর যত্নে লালন করে।
বনভূমি নিধন, মাটি, পানি, বাতাস ও শব্দ দূষণের ব্যাপকতা বেড়েই চলেছে এতে করে বিভিন্ন বিপর্যয় প্রতিশোধ করার ক্ষেত্রে পরিবেশের ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এ সমস্ত বিপদগুলো ছাড়া মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে গ্রিনহাউজ গ্যাসের বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিই ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্প সমৃদ্ধ দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনলেই প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে মুক্তি পাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো।
আসুন বেশী বেশী গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করি। গাছ লাগালে পরিবেশ প্রকৃতি বাঁচবে, প্রকৃতি বাঁচলে পৃথিবী বাঁচবে, পৃথিবী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। সবুজে সবুজে ভরপুর হয়ে উঠবে পুরো পৃথিবীর সাথে আমাদের প্রিয় লাল সবুজের বাংলাও। প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলি :
‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে।’
লেখক : প্রাবন্ধিক