পাহাড়ী অঞ্চলে কফি চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

ড. মো. জামাল উদ্দিন | সোমবার , ১১ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ


কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই! মান্না দে’র সেই ঐতিহাসিক গানটি আবার সূর পাক, কফি হাউসের সেই আড্ডাটি আবার জমজমাট হয়ে উঠুক। মান্না দে’র সেই ‘স্বপ্নের কফি হাউস’ দেশের পরতে পরতে গড়ে উঠুক সে আশা নিয়ে আজকের লিখাটি শুরু করতে চাই। কফি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়। বিশ্বে প্রতিদিন আনুমানিক ২০০ কোটি কাপ কফি পান করা হয়! বাংলাদেশে এর জনপ্রিয়তা বহুকাল থেকেই। তবে অভিজাত হোটেল বা বাসাবাড়িতে এর কদর বেশি থাকলেও বর্তমানে কে না চায় কফির স্বাদ নিতে। তবে এর স্বাদ ও সাধ্যের সমন্বয় ঘটাতে হলে এর সহজলভ্যতা দরকার। সহজলভ্য করতে হলে দেশে এর ব্যাপক চাষাবাদ বাড়াতে হবে। কেননা দেশে শতকরা ৯৫ ভাগ কফি আমদানি করতে হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২ দশমিক ৫১৭ মেট্রিক টন গ্রিন কফি আমদানি করতে হয়েছে। বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকার আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে এনে দেশে এসব কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে রপ্তনির উপর জোর দিচ্ছে। তার জন্য নতুন নতুন প্রকল্পও গ্রহণ করছে।
দেশে কফি ও কাজুবাদামের উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করার লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় একটি যুগোপযোগী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, এমপি এর আন্তরিক প্রচেষ্টার বদৌলতে ৫-বৎসর মেয়াদী কফি ও কাজুবাদাম গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তব রুপলাভ করেছে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যৌথ উদ্যোগে তিন পার্বত্য জেলা ও টাঙ্গাইলসহ দেশের ৪টি বিভাগে ৯টি জেলার ২২ টি উপজেলায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। কফি ও কাজুবাদামের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, এলাকা উপযোগী উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন, টেকসই উৎপাদন ও ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা এবং মান-সম্মত গবেষণার জন্য পরিকাঠামো উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণমূলক কাজ জোরালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
কফি নিয়ে আলোচনা করার আগে এর পুষ্টিগুণ বা পান করার উপকারিতা নিয়ে খানিকটা আলাপ করা যাক। পুষ্টিগুণ আর অ্যান্টিঅঙিডেন্টে ভরপুর এই পানীয়টিতে রয়েছে ভিটামিন বি৫, ভিটামিন বি২, থায়ামিন বি১, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম। কফিতে ক্যাফেইন নামক এক প্রকার উত্তেজক পদার্থ রয়েছে। আট আউন্স কফিতে প্রায় ১৩৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। ক্যাফেইনের জন্যে কফি মানুষের উপর উত্তেজক প্রভাব ফেলে ও উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। চায়ের পর কফি বিশ্বের অত্যধিক জনপ্রিয় পানীয়। ক্যাফেইন যুক্ত কফি খেলে খেলাধুলায় প্রাণ পাওয়া পায়, হৃদপিণ্ডের গতি বাড়ায়, ওজন কমায়, শরীরে উদ্যম ও উৎসাহ তৈরি করে, তারুণ্য ভাব ধরে রাখে, মানসিক শক্তি যোগায়, মনযোগ বৃদ্ধি পায়, আলঝেইমার (স্মৃতিভ্রংশ) রোগের জন্য সহায়ক, ক্যান্সার ও টাইপ টু ডায়াবেটিস রোগের ঝুঁকি কমায়। এক কথায় কফির গন্ধই আপনাকে অনেকখানি চাঙা করে দেয়। আর পেটে কফি পড়লে মনের বিষাদভাব কাটতে বেশি সময় লাগে না। তবে অস্ট্রেলিয়ার স্নায়ুবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের মতে, যাঁরা হরমোনের সমস্যায় ভুগছেন তাঁদের কফি এড়িয়ে চলাই ভালো।
কফি শুধু পানীয় নয় এটি বিশ্বের ১২ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জীবিকার অবলম্বন। ফেয়ারট্রেড ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত গ্রীষ্মকালীন পণ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম কফি। ইন্টারন্যাশনাল কফি অর্গানাইজেশনের তথ্য মতে, ১৯৯১ সালে সারা বিশ্বে ৬০ কেজি ওজনের কফির ব্যাগ বিক্রি হয়েছিল ৯ কোটি। সেটি ২০১৮ তে এসে ১৬ কোটিতে দাঁড়ায়। কফির জন্মস্থান ইথিওপিয়া। ইথিওপিয়ায় জন্ম নেয়া কফি গাছ থেকে পাওয়া কফিকে বলা হয় অ্যারাবিকা। এই ধরনের কফি সাধারণত মিহি, হালকা এবং সুঘ্রাণযুক্ত। এই জাতের কফির দামও অপেক্ষাকৃত বেশি। বিশ্বের প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ কফিই এই জাতের। স্বাদে কিছুটা তিতকুটে এবং অতিরিক্ত ক্যাফেইন সমৃদ্ধ আরেক ধরণের কফি হলো রোবাস্টা। এই ধরনের কফি সাধারণত ইন্সট্যান্ট কফি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু এলাকায় এবং ব্রাজিলে সাধারণত এধরণের কফি জন্মায়। ইউএসডিএ ‘কফি ওয়ার্ল্ড মার্কেটস অ্যান্ড ট্রেড’ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১-২২ মৌসুমে কফির ব্যবহার গত মৌসুমের তুলনায় ১ কোটি ৮০ লাখ ব্যাগ (প্রতি ব্যাগে ৬০ কেজি) বাড়বে। সে অনুযায়ী কফি উৎপাদন না বাড়লে সরবরাহে ঘাটতি পড়বে। বিশ্বের শীর্ষ কফি উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিলের পর দ্বিতীয় ভিয়েতনাম। বিগত মৌসুমে ব্র্রাজিলের মোট কফি উৎপাদন প্রায় ৬ কোটি ৯৯ লাখ ব্যাগ (প্রতি ব্যাগে ৬০ কেজি)।
বাংলাদেশের পাহাড়ঞ্চল কফি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ১২ শতাংশ জমির এলিভেশন প্রায় ১০০০ মিটার। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য এলাকা ছাড়াও টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, সিলেটের জৈন্তপুর, মৌলভীবাজারের আকবরপুর এবং গাজীপুর সহ উত্তরবঙ্গে বেশ কিছু পাহাড়ি জায়গায় কফি চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব এলাকায় কফি ভালো ফলন দিচ্ছে সেসব এলাকা বাছাই করে বাণিজ্যিক চাষাবাদের দিকে যাওয়া যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে কনট্রাক্ট ফার্মিং করলে কৃষক লাভবান হবে। মান-সম্মত কফি উৎপাদন সম্ভব হবে। প্রত্রিয়াজাতকরণ ও বিপনন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে কৃষক উৎপাদনে আগ্রহী হবে। কফি চাষের জন্য গভীর, ঝুরঝুরে, জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ও হিউমাস সমৃদ্ধ, হালকা অম্ল মাটি (পিএইচ ৪.৫-৬.৫) হলে বেশ ভালো। কফি হালকা ছায়ায় ভালো হয়। কফি বাগানে হালকা ছায়া প্রদানকারী গাছ থাকা ভালো। সুষম মাত্রায় সার ও শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা করা গেলে ভালো ফলন দেয়। কফির সাথে আন্তফসল হিসেবে পেঁপে, আনারস, গোলমরিচ, অড়হর চাষ করলে অতিরিক্ত আয় হয়। সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে কফি গাছে ফুল আসে এবং নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা হয়। প্রতি সোয়া ৬ কেজি তাজা কফি ফল থেকে ১ কেজি শাঁসযুক্ত কফি বিন পাওয়া যায়। প্রতি ১ কেজি শাঁসযুক্ত কফি বিন থেকে ৭৫০ গ্রাম ফ্রেশ কফি বিন বা বীজ পাওয়া যায়। বিভিন্ন খরচ বাদ দিলে কফি চাষ করে পাহাড়ি কৃষকরা একর প্রতি বছরে প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা নিট আয় হয় বলে জানা যায়। পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, খাগড়াছড়ি ২০০১ সাল থেকে পরীক্ষামূলকভাবে কফি চাষ শুরু করে। ফলাফল ও বেশ আশাব্যঞ্জক।
বাণিজ্যিকভাবে চাষযোগ্য ২টি কফি প্রজাতির মধে কফি এরাবিকা এবং কফি রোবাস্টা অন্যতম। রোবাস্টা জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বেশ উপযোগী এবং এই জাতের কফি গাছে রাস্ট রোগ কম হয়। এটি সাধারণত সমুদ্র থেকে ৫০০-১০০০ মিটার উচ্চতায় এবং ১০০০-২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ভালো ফলন দেয়। পাহাড়ের অনাবাদি ১ লাখ হেক্টর জমিতে কফি চাষ করতে পারলে ২ লাখ টন কফি উৎপাদন সম্ভব যার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা হবে বলে এক প্রতিবেদনে দেখা যায়। সরকারী পৃষ্টপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোক্তা ও বড় বড় প্রক্রিয়াজাত কোম্পানীগুলো বাণিজ্যিকভাবে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এর মাধ্যমে কফি চাষে এগিয়ে আসলে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও একটি কফি উৎপাদনকারী ও রপ্তানীকারক দেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করবে। এতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। কফি আমদানির নির্ভরতা কমবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হবে এবং দেশ ও জাতি আরো সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, উপ-প্রকল্প সমন্বয়কারী পরিচালক, কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প (বারি অঙ্গ); ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,
আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাজনীতিবিদ বিপ্লবী অধ্যাপক পুলিন দে
পরবর্তী নিবন্ধহযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (দ.) শান্তির অগ্রদূত