সরকারি সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশের অন্যতম বৃহৎ পাটকল আমিন জুট মিল ইজারা দেয়ার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে মিলের মালিকানাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও জমি ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ভূমি ছাড়াও কোটি কোটি টাকা দামের যন্ত্রপাতিসহ পুরো মিলটিই ইজারা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মিলের মালিকানাধীন কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠেছে।
সূত্র জানায়, মাথাভারী প্রশাসন, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, রকমারি অনিয়ম, উদাসীনতা এবং সর্বোপরি দুর্নীতির ফলে দেশের সরকারিখাতের পাটকল শিল্পে ধস নেমেছে। বেসরকারিখাতে পাটকল শিল্পের ব্যাপক প্রসার এবং বিস্তার ঘটলেও বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকলগুলো লাটে উঠেছে। দেশের সরকারিখাতের ২৬টি পাটকলের বেহাল দশায় বছর তিনেক আগে সবগুলো মিলই একযোগে বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে মিলগুলোর চাকা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ আমিন জুট মিলসহ দশটি মিল রয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কারখানার শ্রমিকদের বিদায় করে দেয়া হয়েছে। তবে আমিন জুট মিলের ১৩০ জনের মতো কর্মকর্তা–কর্মচারী চাকরিতে রয়েছেন। উৎপাদন না থাকলেও কারখানার সম্পদ রক্ষাসহ নানা কার্যক্রমে কর্মকর্তা–কর্মচারীরা জড়িত রয়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, বিজেএমসির অন্যতম বৃহৎ কারখানা হিসেবে ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় আমিন জুট মিল। নগরীর মুরাদপুর এলাকার ৭৯ একর জায়গার উপর গড়ে তোলা হয়েছিল এটি। ১৬৬ হেসিয়ান, ২৭৫ সেকিং, ৩৩ সিবিসি ও ১ হাজার ৩৪৪ অন্যান্য লুম নিয়ে গড়ে তোলা হয় বৃহৎ এই পাটকল। কারখানাটিতে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। এর মাসিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৮৫ মেট্রিক টন হেসিয়ান, ৯৯৩ মেট্রিক টন সেকিং, ৭২ মেট্রিক টন সিবিসি ও ১৪৪ মেট্রিক টন অন্যান্য লুম। দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত মেশিনগুলোর অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছিল একেকটি মেশিন। আবার কোনোটি সচল হলেও তার স্থায়ীত্ব ছিল খুবই কম। এতে দিনে দিনে প্রচুর লোকসানের মুখে পড়া কারখানাটি বন্ধ করে দেয়ার কোনো বিকল্প ছিল না বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সূত্র বলেছে, কারখানাটি বেসরকারি খাতে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে আয়ুস্কাল ফুরিয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতিসহ কারখানাটি আদৌ বেসরকারি কোনো কোম্পানি ইজারা নেবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে কারখানার কোটি কোটি টাকার ভূমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা ইজারা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে অফিসার্স ক্লাব, বেশ কয়েকটি দোকানসহ জমি ইজারা দেয়া হয়েছে। আরো কিছু স্থাপনার ইজারা প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে কারখানাটির প্রায় সব স্থাপনাই ইজারা প্রদান করা হবে। ইতোমধ্যে গুদাম এবং গ্যারেজের জায়গা ভাড়া দেয়ার কথা বলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।
কারখানাটিতে আনসার পাহারা থাকলেও দামি জিনিসপত্র চুরি হওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। তবে কারখানার কয়েক হাজার কোটি টাকার ভূসম্পত্তি রক্ষা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। আমিন জুট মিলের নামে শহরের বুকে ৭৯ একর বা প্রায় ৪ হাজার ৭৮০ কাঠা জায়গা রয়েছে। এই জায়গার বর্তমান বাজারদর কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল ভূসম্পত্তির মধ্যে প্রায় ২৫ একর জায়গা ইতোমধ্যে বেদখল হয়ে গেছে। বেদখল হয়ে যাওয়া জায়গার দাম অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা বলেও সূত্র জানিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে কারখানার জায়গা বেহাত হয়েছে। এই বেহাত কার্যক্রমের সাথে স্থানীয় বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানও জড়িত রয়েছে। আমিন জুট মিলে চাকরি বাকরি করতেন এমন অনেকেও জায়গা দখল করেছে। মিল কর্তৃপক্ষ অনেকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলেও কোনো সুফল আসেনি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকার ইজারা দেয়ার আগে বড় ধরনের অভিযানের মাধ্যমে বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধার করবে।
গতকাল আমিন জুট মিলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কারখানাটির অবস্থা খুবই শোচনীয়। যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। জং ধরেছে লোহায়। আনসারের পাহারা থাকলেও প্রভাবশালীদের অনেকেই জায়গা দখল করে নিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের সীমানা দেয়া আছে। সীমানার বাইরেও আমাদের কিছু স্থাপনা রয়েছে। সবকিছু মিলে আমাদের সম্পত্তিগুলো রক্ষা করাই কঠিন হয়ে উঠেছে। সরকার মিলের বিভিন্ন স্থাপনা এবং মিলটি ইজারা দেয়ার চেষ্টা করছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিছু কিছু স্থাপনা ইজারা হয়েছে। তবে মিল পুরোপুরি ইজারা না দেয়া পর্যন্ত এই খাত থেকে যা আয় হবে তা দিয়ে বর্তমান খরচ মেটানো সম্ভব হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।