দুটো ছেলে নিয়ে মেধা যুদ্ধ করে চলেছে। আবেগের এই হঠাৎ চলে যাওয়া মেধার মাথার ওপরের ছাদ আর পায়ের তলা থেকে মাটি দুটোই সরিয়ে দিয়েছে। দুই ছেলে নিয়ে সংসার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে ও। আবেগ বেঁচে থাকতে সংসার ছেলেমেয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকত সে। শ্বশুর-শাশুড়ি ননদ দেবর সবার কাছে প্রিয় নাম ছিল ‘মেধা’। দু’ছেলে নিয়ে সুখের সংসার, কোনকিছুর অভাব ছিলনা। হঠাৎ স্বামীর ক্যান্সার ধরা পড়ে, দু’বছর যুদ্ধ করে অবশেষে হেরে যায় আবেগ। শুধু মেধাই জানে এ দুটো বছর ওর ওপর দিয়ে কী গেছে! ছেলেদুটো এখনো ছোট, থেমে গেলে চলবে না। জীবনযুদ্ধ কেবল শুরু হয়েছে। আবেগ বেঁচে থাকতে মেধা শুধু ঘর সামলেছে সাথে আত্মীয়তা রক্ষার সামগ্রিক দায়িত্ব ছিল তার ওপর। ব্যাংক বা কোন অফিস সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই মেধার। ব্যাংকে কোন এ্যাকাউন্টও নেই। আর পাঁচজন সাধারণ গৃহিনীর মত পুরোপুরি স্বামীর ওপর নির্ভরশীল ছিল সে এসব ব্যাপারে। বাবা আর ভাইদের সাথে স্বামীর অত্যন্ত সু-সম্পর্ক। বিষয় সম্পত্তি নিয়ে সে কোনদিন মাথা ঘামায়নি। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর শ্বশুর, দেবর সামলেছে সব ব্যাংকের কাজ। বিষয় সম্পত্তি নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতে আত্মসম্মানে খুব লাগতো তার। তবুও এক শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে, আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে একদিন মেধা আবেগকে বলেছিল কাগজপত্র সব তাকে দেখিয়ে এক জায়গায় রাখতে। আবেগে’র জবাব ছিল,‘সব বাবা’র কাছে রাখা আছে। আমার ভাইয়েরা কোনদিন তোমাকে ঠকাবেনা। আমার যা আছে সবই বাবা ভাইয়ের কাছে সুরক্ষিত আছে, তোমার যখন যা প্রয়োজন ওদের বললেই হবে’। মেধাও মনে প্রাণে তা-ই বিশ্বাস করতো। স্বামীর জবাবে আশ্বস্ত হয়ে আর দ্বিতীয়বার কিছু বলেনি।
আবেগে’র মৃত্যুর পর মাসে মাসে কিছু টাকা দিয়ে আসছিল দেবর। ছ’মাস না যেতেই হঠাৎ মেধার শ্বশুর মারা যায়। অল্পকিছুদিনেই শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের আচরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। শ্বশুর বাড়িতে গেলেই জা’ মনে করে কিছু বুঝি চাইতে এসেছে। এরই মাঝে মেধা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে একটা কাজের, এক শুভাকাঙ্ক্ষীর সহায়তায় পেয়েও যায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষিকার একটা চাকরি। আবেগে’র কেনা একটা জমি বেহাত হয়ে যাবার আশংকা দেখিয়ে দেবর তা বিক্রি করে নামমাত্র অর্থ ভাইয়ের বৌয়ের হাতে তুলে দেয়। মাসে মাসে দেবর যে টাকাটা দিত তা বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকজন বন্ধু মিলে আবেগ একটা ফ্ল্যাটের কাজ শুরু করেছিল। বছর পর ওই ফ্ল্যাটের খোঁজ নিতে গিয়ে কোথাও আবেগের নাম পাওয়া যায়নি। বন্ধুরা কিছু টাকা তার একাউন্টে জমা করে কৌশলে সব কাগজপত্র থেকে ওর নাম সরিয়ে দেয়। মেধার কাছে কোন কাগজ না থাকায় সে কিছুই করতে পারছে না। সুসময়ের স্বামীর ঘনিষ্ট বন্ধুরা এখন আর বন্ধুপত্নীকে চেনেনা। বন্ধু সন্তানের অসহায় মুখচ্ছবি তাদের প্রাণে একটুও নাড়া দেয় না।পৃথিবীটাই স্বার্থপর, কিন্তু বেঁচে থাকতে তা অনেকেরই বোধগম্য হয়না। নিজ স্ত্রী’র চাইতে অন্য সবাইকে অনেক আপন মনে করে এরা।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো বিশ্বাস। আমরা একে অপরের অর্ধ অঙ্গ বলেই জানি। যতদিন যাচ্ছে সম্পর্কগুলো স্বচ্ছতা হারাচ্ছে। আমাদের (বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে) পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষদের ধারণা স্ত্রী’ এসব সামলাতে পারবে না। স্ত্রীর হাতে গেলে কষ্টার্জিত টাকাপয়সা / জমিজমা যতটুকুই আছে, না বুঝে তা নষ্ট করে ফেলবে। বাস্তবে কিন্তু হয় ঠিক তার উল্টো। কষ্টার্জিত জমানো অর্থ স্ত্রী/পরিবার না জানার কারণে ভূতের ভোগদখলে চলে যায়। অথচ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে স্বামীর অবর্তমানে এই স্ত্রী’কেই সাগরে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করে করে সাঁতার শিখেই নিতে হয় । কোন কোন পুরুষের অদূরদর্শীতার জন্যও এমনটাও হতে পারে, তাদের এই বোধটাই নেই যে স্ত্রী’র সাথে সব শেয়ার করা প্রয়োজন। বেঁচে থাকতে এরা বোঝেনা মৃত্যু’ যে কোন সময়ে যে কোন কারো দরজায় কড়া নাড়তে পারে। কিছু সংখ্যক ব্যতিক্রমধর্মী স্ত্রী থাকলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু ভুক্তভোগী ।
আমাদের গড় আয়ু বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে অসময়ে মৃতের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। মহিলা যদি আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, তাহলে তেমন অসুবিধা হয় না, কারণ যত লাখ টাকাই ইনকাম করুক না কেন সে তো স্ত্রী, তাই স্বামী বা পরিবারকে না জানিয়ে বেশী টাকা ইনভেস্ট করার সাহস তার কখনোই হবেনা। মহিলারা লুকিয়ে স্বামীর পকেট মারিং করে কিছু টাকা সরিয়ে রেখে, অসময়ে সংসারেরই কাজে সে টাকা খরচ করতে পারবে। অথবা অসময়ে স্বামীর হাতে ওই জমানো টাকা তুলে দিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারবে। কিন্তু স্বামী পরিবারকে না জানিয়ে লুকিয়ে সম্পত্তি রাখা বা ফ্ল্যাট কেনা বা ব্যাংকে টাকা জমিয়ে রাখা কোনদিনই পারবে না। স্বামী প্রবরটি অনায়াসে এ কাজগুলো করে থাকেন। স্ত্রী বিয়োগের পর স্বামী নিজে চলার জন্য একজন সাথী প্রয়োজন হয়। কিন্তু স্বামীহারা নারীকে সন্তান /পরিবার নিয়ে নেমে পড়তে হয় জীবনযুদ্ধে।
আমাদের চারপাশে তাকালেই শত শত উদাহরণ দেখতে পাই। প্রায় প্রতিটা পরিবারের কাউকে না কাউকে এ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে কিন্তু তবুও আমাদের পুরুষদের মনোভাব বদলাচ্ছেনা এতটুকু, বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে শেয়ার না করার প্রবণতা। ইদানীং তো আবার কাউকে কাউকে বলতে শোনা যাচ্ছে ‘স্ত্রী’কে সুখী করতে সীমিত পরিসরে সত্য গোপন করা যেতে পারে’! এ কোন ধরনের সুখ তা সত্যিই বোধগম্যের বাইরে।
মানুষ কষ্ট করে রোজগার করে স্ত্রী, সন্তান পরিবার পরিজনকে একটু ভালো রাখবে বলে। ভরণপোষণ চালিয়ে অনেক কষ্টকরে সাধ্যমত টাকা জমা রাখে ভবিষ্যতে তার পরিবার পরিজনকে যেন কারো দ্বারস্থ হতে না হয়, তার জন্য।
কিন্তু পরিবার পরিজন যদি তার অনুপস্থিতিতে কি আছে না আছে তাইই না জানে, তাহলে তো সব হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমার মনে হয় ব্যাংকে এ ধরনের সমস্যার কারণে আনক্লেইম্ড অবস্থায় পড়ে থাকা অর্থের পরিমাণ/ বিনিয়োগের পরিমাণ নেহায়েত কম হবে না।
যে সময় পার করছি তাতে কেউই জানিনা কাকে কখন সব ছেড়ে যাত্রা করতে হবে অজানার পথে। পারিবারের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে এই সত্যটা আমরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারবো ততই মঙ্গল।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার