‘সকল ঈদের সেরা ঈদ, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোমিনেরই ঈদ’।
মহান আল্লাহর অপার রহমত ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় মানবতার মুক্তির দূত রহমাতুল্লিল আলামিন প্রিয়নবী (দ.) এর পৃথিবীতে শুভাগমনের আনন্দকেই ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.), বলা হয়। যার নূরের আলোয় সারা পৃথিবীতে শুভাগমনের আনন্দকেই ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)’ বলা হয়। যার নূরের আলোয় সারা পৃথিবী আলোকিত হয়েছিল। তার ওপরই নাজিল হয়েছে আসমানি গ্রন্থ আল– কোরআন।
জশনে শব্দের অর্থ খুশি উদ্যাপন করা, আনন্দ প্রকাশ করা আর জুলুছ শব্দের অর্থ বিশেষ কোনো উপলক্ষকে সামনে রেখে অনেক লোক জমায়েত হয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করা (ফিরুজুল লুগাত)। সুতরাং জশনে জুলুছ এর অর্থ হলো গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়কে উপলক্ষ করে রাজপথে আনন্দ মিছিল করা, যা হবে নেয়ামতের শোকর (কৃতজ্ঞতা) আদায়ের বহিঃপ্রকাশ।
বর্তমান বিশ্বের মুসলমানদের কাছে জশনে জুলুছ আর অপরিচিত কোন বিষয় নয়। বিশ্বনবী রাহমাতুলল্লিল আলামীন হুজুর মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিশাল রহমত এর ভাণ্ডার নিয়ে পৃথিবীর বুকে শুভাগমন করেছিলেন সে নেয়ামত কেবল মানবজাতির জন্য নেয়ামত এমনটি নয়, বরং তা ছিল সমগ্র বিশ্বভ্রমান্ডের আঠার হাজার মাখলুকাতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। তাই এই মহান দিবসকে উপলক্ষ করে প্রতি বৎসর ঐ দিনে নেয়ামতের শোকরিয়া প্রকাশের নিমিত্তে মিলাদ মাহফিল করা জিকির আজকার করা আনন্দ উদযাপন করা জশনে জুলুছ করা কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয় বরং বড় ফজিলতপূর্ণ ইবাদতের কাজ।
বিশ্বমানবতার মুক্তির বাণী নিয়ে আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে যিনি এ পৃথিবীতে অফুরন্ত আল্লাহর রহমত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যাঁর স্পর্শে মানবতার ক্ষীণকায় প্রদীপ আবার প্রজ্জ্বলিত হয়ে বিশ্বমাঝে নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলঃ যখন মানুষ বিবেকের বন্ধাত্বের কারণে মস্তিষ্কের বন্দীদশা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। যখন একজনের ভাগ্য আরেকজনের অনুগ্রহ ও করুণার উপর নির্ভরশীল ছিল, মানুষ যখন দাশ প্রথার অক্টোপাসের শিকারে পরিণত হয়ে ক্রমাগত একে অপরের জেলখানায় বন্দী হচ্ছে, যখন মানুষ যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে সেভাবে নিজের লোভ, কাম, লালসা চরিতার্থ করছে, সামগ্রিক ভাবে বলতে গেলে যখন মানুষের আত্মার উপর পশুত্ব জবরদস্তী চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম পবিত্র মক্কার জমিনে আগমন করেছিলেন। যাঁর আবির্ভাব আল্লাহর গোটা সৃষ্টি জগতকে গৌরবান্বিত করেছে, মর্যাদাশীল করেছে। যিনি সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে থেকে সৃষ্টি কল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন।
যিনি ধুলায় লুণ্ঠিত মানবতার ছাই ভষ্মের উপর জাগরণের শ্লোগান তুলেছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর বেলাদত (জন্ম) মানব জাতির মুক্তির বড় উপলক্ষ। তিনি বিশ্ব মানবতার মুক্তির পথ প্রদর্শক হিসেবে দুনিয়াতে এসেছিলেন। তাই তাঁর আবির্ভাব মানব জাতির জন্য আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ ও নেয়ামত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ অনুগ্রহ বা নেয়ামত প্রাপ্তির পর খুশী ও আনন্দ উদযাপনের জন্য মানুষের প্রতি আল্লাহর তাগাদা রয়েছে। এ খুশী বা আনন্দ বিশেষ গোষ্ঠী দল বা দেশের জন্য সীমাবদ্ধ নয় এ খুশী সমগ্র মানব জাতির জন্য।
যেহেতু আল্লাহ ঘোষণা করেছেন
‘আল্লাহতায়ালা প্রিয় নবী (দ.) কে দু’জাহানের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছেন, আল্লাহর নবীকে দুনিয়ায় প্রেরণ মানুষের প্রতি স্রষ্টার বড় করুণার নিদর্শন। যারা এতবড় অনুগ্রহ প্রাপ্তির পরও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে না তারা কেয়ামত পর্যন্ত অকৃতজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি বহন করবে।
আজকের আধুনিক যুগ সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী মানুষের বিশেষ বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাদের জন্ম–মৃত্যু দিবস খুব ঘটা করে পালন করে থাকেন। অথচ যাঁর অবদান মানব জাতির সকল দিকেই রয়েছে, যিনি মানুষের নৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সহ সকল বিষয়ের বিজ্ঞান সম্মত সমাধান দিয়ে গেছেন তাঁর জন্মকে উপলক্ষ করে মানুষকে কতটুকু খুশী উদযাপন করা উচিত? এ ব্যাপারে আল্লাহ মানব জাতিকে স্বরণ করিয়ে দিয়ে এরশাদ করেন–
‘মুমিনদের কাছে রাসুল প্রেরণ করা আল্লাহ তায়ালা বড়ই অনুগ্রহ ও এহসান করেছেন।’ যেদিনে মানব জাতি এমন নেয়ামত ও আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়েছে– সেদিনে ঈদ উদযাপনের কথা। পবিত্র কোরানে আল্লাহ আরো বলেছেন ‘হে বনী ইসরাইল তোমরা স্মরণ করো, যে সব নেয়ামত আমি তোমাদেরকে দান করেছি। আল্লাহ বণী ইসরাইলের প্রতিদেয় নেয়ামতকে স্মরণ করতে বলেছেন। অর্থাৎ নেয়ামত প্রাপ্তির জন্য খুশী হতে বলেছেন, তুষ্ঠ হতে বলেছেন। ঠিক একইভাবে বিশ্বমানবতার জন্য হযরতের আবির্ভাব আল্লাহর অপরিসীম দান বা রহমত। অবশ্যই এ নেয়ামতকে উপলক্ষ করে মানুষকে খুশী উদযাপন করতে হবে। এ নেয়ামত প্রাপ্তির যথাযথ কদর বা শুকরিয়া আদায় করতে হবে।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজ থেকে চৌদ্দ’শ বৎসর আগে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে, বহুত্ববাদের বিরেুদ্ধে একত্ববাদের কথা বলে মানুষের মধ্যে অবাঞ্চিত বিশ্বাসের যে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন–আজো এ একত্ববাদকে চ্যালেঞ্জ দেবার ক্ষমতা কারো নেই। অথচ আজো অনেক মানুষ ইচ্ছা অনিচ্ছায় বহু দেব–দেবীর পূজা আর্চনায় লিপ্ত রয়েছে। তারা নিজেরাও জানে না যে এ দেব দেবীর পক্ষে তাদের সকল জিজ্ঞাসার জবাব দেয়া সম্ভব নয়। এমন কি তাদের একান্ত অনুগ্রহ ছাড়া পুজিত দেব–দেবীর নড়া–চড়া করবারও কোন ক্ষমতা নেই। এর পরও তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের প্রথা আঁকড়ে ধরে আছে। অথচ আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) অস্থায়ী এ নশ্বর জগতের পরে অন্তকালীন পরকালীন মুক্তির জন্য মানুষকে অকাট্য দলিলসহ একত্ববাদের কথা বলছেন।
যারা সেদিন আল্লাহর নবীর কথাকে আস্থায় এনে সকল যুক্তি তর্কের উর্ধে উঠে একত্ববাদে বিশ্বাসী হয়েছেন তারা আল্লাহর পরম অনুগ্রহ লাভে ধন্য হয়েছেন এবং বিশ্বাসীদের জন্য কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর রহমতের দরজা খোলা থাকবে।
হযরত মুহাম্মদ (দ.) দুনিয়াতে আবির্ভাবের পর তাঁর দাওয়াতের বিশেষত্ব হচ্ছে– তিনি গোত্র বর্ণ, বংশ, ভাষা ও অঞ্চলের সীমাবদ্দ সকল ব্যবধানকে উপেক্ষা করে মানুষকে মানুষ হিসেবেই আহবান করেছেন। তিনি এমন কিছু মূলনীতি পেশ করেন যা স্থান–কাল পাত্রের উর্ধে সকল মানুষের জন্যই কল্যাণকর। বর্ণের উৎপীড়ন, বংশের বড়াই, জাত–পাতের সকল প্রশ্নের কবর রচনা করে মানুষ হিসেবে মানুষের মানবিক সম্পর্ককে উর্ধে তুলে ধরে প্রিয় নবী (দ.) মানবতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেন। অথচ বর্তমান সভ্য জগতেও মানুষ আজ চরম বর্ণবাদের শিকার। এখনো হিন্দু ধর্মে র্ধান্ধসারীদের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তার মুলোৎপাটন করা বর্তমান বিশ্ব শক্তির পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ সেসব ধর্মই এ বিভক্তি রচনা করে দিয়েছেন।
মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। মানুষ সমাজে বসবাস করে বলেই মানুষ সামাজিক জীব। যে আল্লাহর সম্মুখে জবাব দেবার অনুভূতি রাখে সে নিজের জীবনকে সামাজিক ও ব্যক্তিগত বলে খন্ড খন্ড করতে পারে না। তার মধ্যে ও বিশ্বাস থাকতে হবে যে, সে যদি বেঈমানী করে তাহলে তার জীবন জানোয়ারের চেয়েও খারাপ হবে।
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আমি মানুষকে সর্বোত্তম ভাবে সৃষ্টি করেছি। অত:পর তাকে নিম্নতম পর্যায়ে ফেলে দিয়েছি।’ এভাবেই প্রিয় নবী (দ.) মানুষের জন্য চিরস্থায়ী চারিত্রিক গুণ সম্পন্ন বিধানই কেবল নিয়ে আসেননি–বরং মানুষের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় চরিত্র এবং আচার আচরণের কালজয়ী ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন।
প্রিয় নবী (দ.) দুনিয়াতে আসার পর যাদেরকে নানানভাবে গুনান্বিত করে উৎকৃষ্ট মানুষের পরিণত করেছেন। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবীতে ঐ সমস্ত মানুষকে বন্দী করে মানবতাকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছিল।
সে বন্দীদশা থেকে মানবতাকে মুক্ত করে দুনিয়াকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলেছিলেন প্রিয় নবী (দ.)। বর্তমান কম্পিউটার যুগে আধুনিক বিশ্বের চালচিত্র দেখে একথা স্পষ্ট করে বলা যায় যে আমরা পুনরায় “আইয়্যামে জাহেলিয়ার যুগে ফিরে যাচ্ছি”।
কেউ লাইসেন্স নিয়ে মাস্তানী করছে, আর কেউ বিনা লাইসেন্স সন্ত্রাসী করছে। কেউ লাইসেন্স নিয়ে দুর্নীতি করছে, কেউ বিনা লাইসেন্সে আইন বিরুদ্ধ কাজ করছে। এ হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব সমাজের করুণ চিত্র। নীতি হচ্ছে সমাজের ব্লাড বা রক্ত। রক্ত ছাড়া যেমন মানুষ চলতে পারে না, তেমনি নীতি ছাড়া সমাজ চলতে পারে না। আল্লাহর প্রিয় হাবীব (দ.) যে নীতি প্রতিষ্ঠা করে সমাজে স্পন্দন সৃষ্টি করেছিলেন। সে নীতি আজ মানুষের স্পর্শ থেকে সমান্তরাল দুরে অবস্থান করছে। যার ফলে সমাজ হয়েছে কক্ষচ্যুত। ধীরে ধীরে সমাজের সকল সামাজিক বন্ধনই শিথিল হয়ে গেছে। আজ মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে, সমাজ সমাজের বিরুদ্ধে একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আজ নতুন করে চৌদ্দশত বছরের পূর্বে রাসুলুল্লাহ (দ.) এর প্রতিষ্টিত রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক পদ্ধতি অনুসরণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সর্বোতভাবে। যা এ যাবৎকালের সকল পরীক্ষায় কালোত্তীর্ণতার প্রমান দিয়েছে। মানুষ নিজের মস্তিষ্ক থেকে নতুন নতুন মন্ত্র আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের যুগে মানবতাকে ধষণ করে চলেছে। অথচ এখনো বাঁচার যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারেনি। বরং কারা কত দ্রুত কত বেশী মানুুষ হত্যা করে প্রদর্শনী দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বব্যাপী। সোভিয়াত বিজ্ঞানী আন্দ্রে শাখারত হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কার করে পরে তার ব্যবহারে ব্যাপক গণহত্যা দেখে জীবনের শেষ প্রান্তে তার আত্ম জীবনীতে প্রাশ্চিত্যের কথা বলেছেন।
সমাজ বিপ্লবের যে মন্ত্র প্রিয় নবী (দ.) আজ থেকে প্রায় চৌদ্দশ বছর পূর্বে মানুষকে শিখিয়ে গেছেন, সে মন্ত্র আজ নতুন করে রপ্ত করতে হবে।
এরই প্রেক্ষিতে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে শান্তি ও কল্যাণ ফিরে আসবে, সমৃদ্ধির পথ সুগম হবে। আল্লাহ পাক সবাইকে তার প্রিয় হাবীব (দ.) এর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন ও শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে তার কল্যাণ লাভের যোগ্যতা দান করুক, এবং উভয় জগতের সাফল্য লাভের সুযোগ দান করুক আমিন– বেহুরমতি সাইয়িদিল মুরসালিন, আমিন, ছুম্মা আমিন।
লেখক: অধ্যক্ষ, ওয়াছিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা