মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপ, কুবের, কপিলা আর মালার ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী পড়েছিলাম। নিঝুম দ্বীপ যাত্রাকালে আমাদের বহনকারী স্পিডবোটটি ১৮ নাটিক্যাল মাইল জুড়ে যখন মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের মোহনা হয়ে হাতিয়া উপকূলে ভেড়ার অপেক্ষায়, তখন আমার মনে হচ্ছিল আমরা এখনই পা রাখবো মানিকের সেই কল্পিত ময়না দ্বীপে।
উপকূলের ভাঙ্গন রক্ষায় তীরে অগণিত পাথুরে বস্তা দেয়া ছিল। শুষ্ক মৌসুম বিধায় কোনোরকম কষ্ট ছাড়াই ঘাট পেরিয়ে তীরে উঠলাম। আমাদের এই দ্বীপভ্রমণে মোট ৯জন সফরসঙ্গী। ভ্রমণ আয়োজক সাংবাদিক এজাজ মাহমুদের নেতৃত্বে আমরা হাতিয়ায় পৌঁছে মাইক্রো চেপে সরাসরি সরকারি ডাক বাংলোতে উঠলাম। থাকা এবং খাবারের ব্যবস্থা আগে থেকেই রেডি করা ছিল। হাতিয়ার জনপ্রিয় সব খাবার। হাঁসের মাংস, মহিষের দধি, খেজুরের ঝোলাগুড়, সামুদ্রিক রকমারি মাছ কিছুই বাদ ছিল না। খেয়েদেয়ে দ্বীপ ঘুরতে বের হয়ে প্রথমে কমলার দিঘি বিচ ঘুরে হাতিয়া শিল্পকলা একাডেমির ছাত্রছাত্রীদের সাংস্কৃতিক পরিবশেনা উপভোগ করি। মুগ্ধ হলাম এই দ্বীপাঞ্চলে শিশুকিশোরদের সাবলীল পারফরমেন্স দেখে। শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চায় এদের আন্তরিকতায় মনে আশা জাগলো, মনে হলো নিশ্চয় পথ হারাবে না বাংলাদেশ।
রাতের খাবার ডাক বাংলোতে খেয়ে পরের দিন আবার সড়কপথে আমরা নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশ্যে ঘাটে পৌছালাম। ইঞ্জিন বোটে চড়ে একটি খাড়ি পার হয়েই পা রাখলাম নিঝুম দ্বীপে। নিঝুম দ্বীপ হাতিয়ার ১৬ টি চরের একটি চর। মূল ভূখণ্ডের হাতিয়া সদর উপজেলা থেকে ২ কিলোমিটার দূরে মাত্র একটি ইউনিয়নে ৯টি গুচ্ছ গ্রাম নিয়ে এই দ্বীপ গঠিত বলে জানান বর্তমান স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান দিনাজ। এই দ্বীপের আয়তন মাত্র ৯২ বর্গকিলোমিটার। মোট জনসংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হাজার। দ্বীপের ৭০ ভাগ মানুষ মৎস্যজীবী, বাকি ৩০ ভাগ কৃষিজীবী। পুরো দ্বীপ জুড়েই অগণিত খেজুর গাছ। সামুদ্রিক চেঁওয়া মাছ, ইলিশ মাছ, চিংড়ি আর কোরাল মাছের জন্য বিখ্যাত এই দ্বীপ।বিশাল জাতীয় উদ্যান থাকায় এখানে বিশুদ্ধ মধু আর খেজুরের ঝোলা গুড় পাওয়া যায়। দ্বীপের চারপাশে খাল আর খাড়ি দ্বীপটিকে বেধে রেখেছে বিনিসূতোর মালার মতো।
২০০১ সালে সরকার এখানে একটি জাতীয় উদ্যান গড়ে তোলেন। সেই উদ্যানে হরিণ সংরক্ষণের জন্য সর্বপ্রথম দুইজোড়া চিত্রা হরিণ ছাড়া হয়। সেই দুইজোড়া হরিণ থেকেই এই উদ্যানে এখন রয়েছে প্রচুর হরিণ। স্থানীয় বন কর্মকর্তা জানান, আগে জনপদে হরিণের পাল দেখা যেতো। এখন কম চোখে পড়ে। আবার হরিণ বনবিভাগের লাগানোর চারার কচি পাতা সাবাড় করে। তাই তারা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেয়। ফলে লোকালয়ে এখন আর হরিণ দেখা যায় না। তবে এটি চিত্রা হরিণ প্রতিদিন চলে আসে খাবারের খোঁজে। সে সব খাবার খায়, এলাকাবাসী এই হরিণটিকে অনেক মায়া আর যত্ন করে। সে মায়া আর খাবারের আশায় আসে আবার বনে ফিরে যায়। এই হরিণটাকে দেখলাম খুব কাছে থেকেই। নিঝুম দ্বীপেও আমরা সরকারি ডাকবাংলোয় ছিলাম। আসার পথে দেখলাম একঝাঁক ধবল বকের সারি। ঝাঁক বেঁধেই তারা পুকুরে মাছ শিকারে মত্ত ছিল। আমাদের ত্রিচক্র যানের হালকা নিনাদ–এ তারা ঝাঁকবেঁধেই উড়াল দিল। কি অসাধারণ দৃশ্য! তারা পুকুরের সাথে লাগোয়া গাছে ঝুলে থাকলো সাদা আর ধূসর পাতার মতো। বুঝতে পারলাম এই দ্বীপ পশুপাখিদের কাছে এখনো অনেক নিরাপদ। পকুর আর জলাশয়ে রাজহাঁস, পাতিহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে নির্বিঘ্নে। ডাকবাংলোতে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। শীতের তীব্রতা ছিল না, কিছুটা উষ্ণ, কিছুটা শীতল এমন পরিবেশে আমরা দ্বীপের প্রধান বাজার নামাবাজার হয়ে গেলাম সাগরতটে। সূর্যাস্ত না দেখলেও তার রেখে যাওয়া লাল আভায় এই নিঝুম সাগরতটে যেন অন্যরকম নিরিবিলি বালুকাতট দেখলাম। নবকুমার বোধহয় নৌকাপথে হারিয়ে গিয়ে এমনই নির্জন এক বালুকাতটে সুরালোকে সন্ধ্যাকালেই কাপালিক আশ্রিতা কপালকুণ্ডলাকে দেখেছিল। আর তখনই কপালকুণ্ডলার প্রশ্ন ছিল, পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?
আমরা ফিরে এসে হাটে চা জিলাপি আর পেঁয়াজু খেয়েই ফিরে এলাম ডাকবাংলোতে। ছোট দ্বীপের ছোট্ট একটি হাটখোলা। হাটজুড়েই সাধারণ ও অসচ্ছ্ব্ল মানুষ। মানুষ বলতে পুরুষমানুষ। আমরা মাত্র ক’জন মেয়ে মানুষ যেন এই হাটে চলাচলকারীদের কাছে বিস্ময় ! কারণ এখানে কোনো নারী বাইরে বের হন না। তারা ঘরেই থাকে। একটি মাত্র জুনিয়র হাই স্কুল রয়েছে। উপর ক্লাসে পড়তে হলে হাতিয়া গিয়েই পড়তে হবে। চিকিৎসার জন্য যেতে হবে খাল পেরিয়ে হাতিয়া উপজেলায়। সকালে ঘুরতে গেলাম ডাকবাংলোর পাশে ছোট খালে। সেখানে বিশাল বিশাল নৌকা সারি সারি বাধা। সামনে ঘাট। ধীবররা ফিরছে মনপুরা দ্বীপ থেকে। মনপুরা শুনেই সেই সিনেমার চিত্রপট চোখে ভেসে উঠলো। কথা হলো মাছশিকারী আবদুর রউফের সাথে। তার বাড়ি মনপুরায়। তাকে জিজ্ঞেস করলাম মনপুরা যেতে কতক্ষাণ লাগবে। সে জানায়, বড়োজোর এক ঘণ্টা, তা ও আবার জোয়ার থাকলে আধাঘণ্টায় পৌঁছানো যাবে। সে সকালে সাগর থেকে ইলিশ ধরেছে ১৬ হালি। তাই তার মন বেজাড় মাছ বেশি পায়নি বলে। তার কাছে জানতে চাইলাম কেমন চলছে দিনকাল। বললো ভালোই চলে যাচ্ছে দিন ভালোতে মন্দতে। কোন আক্ষেপ নেই, চাহিদাও নেই, কি সাদামাটা জীবন। নাগরিক জীবনের চাকচিক্য আর বিলাসিতার অনেক উপখা্যান সে জানে না, জানবেনাও কোনোদিন। মনে হলো তার জানারও বা কি দরকার! ঘাট দেখে আমরা গেলাম জাতীয় উদ্যানে। উদ্যানের পাশেই খাড়ি। খাড়িতে সব কেওড়া গাছ। মূল আর শিকড় সারি সারি। স্থল ভূমিতেও কেওড়ার শিকড় ছোট ছোট মূলের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বন ঘুরতে গিয়ে একটু হোঁচট খেেেলই নখ উল্টে গিয়ে আছাড় খাবার শংকা। বনে প্রবেশ পথে কাঠের সাঁকো পেরুতে হয়। বন ঘুরে আবার যাত্রা পালকির চর সমুদ্র সৈকতে। বিশাল এলাকা জুড়ে বালুকাতট। ভাটা থাকায় সমুদ্র ছিল অনেক দূরে। ম্যানগ্রোভ, ঝাউবন আর বালিয়ড়ি দেখেই ফিরে এলাম গন্তব্যে। এবার ফেরার পালা। বড় ঘাটে নয়, ছোট খাড়িঘাটে দাঁড়ানো ছিল স্পিডবোট। স্পিডবোটে উঠে বিদায় জানালাম নিঝুম দ্বীপকে। খাড়িপথে ছুটে চলেছে স্পিডবোট। একজন চালক, একজন হেল্পার। তারা বয়সে একেবারেই নবীন। মনে মনে প্রভুকে ডাকছি। খাড়ি পেরিয়ে মেঘনাবক্ষে গিয়ে পড়লাম। পলিবিধৌত বিধায় খাড়ি এবং নদীর জল একবারেই ঘোলা ছিল। কিন্তু যেই না মোহনা ছাড়িয়ে সাগরে গিয়ে পড়লাম, তখন জলরাশি নীল সবুজে মিশেলে অপূর্ব। মোহনা পেরুতেই জলের পার্থক্য স্পষ্ট। একদিকে ধূসর বর্ণের ঘোলাজল, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির বিশাল জলতরঙ্গ। যেদিকে তাকাই কোনো কূলকিনারা নেই, কেবল জল আর জল। ভয়ে জান ওষ্ঠাগত। অজানা আতংক। এরপরও যেন আনন্দিত, কিছুটা শিহরিতও। কারণ বিশাল সাগরবক্ষে এই প্রথম জলভ্রমণ আমার। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সাগরে স্পিডবোটে বসে অবশেষে উপকূলের দেখা পেলাম। কূলে উঠেই আবার সেই চেয়ারম্যান ঘাটে পৌঁছেই আমাদের সাগর যাত্রার পরিসমাপ্তি। ঘাটে এসেই হোটেলে স্পেশাল দুপুরের ভোজ, এরপরে পুনরায় মাইক্রো চেপে চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা। তিনদিনের হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ সফর আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় যুক্ত করলো নতুন এক উপাখ্যান।