চট্টগ্রামের নাটক সুদীর্ঘকাল এ অঞ্চলের সমাজজীবনকে ধারণ করে আমাদের কালে এসে পৌছেছে। তাতে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের পরিচয়। আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে প্রকাশিত হয়েছে সাহস, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও অর্জনের ধ্রুপদী আখ্যান। আমাদের মহত্তম ঘটনার নাম মুক্তিযুদ্ধ– যুগপৎ আনন্দ ও বেদনার অনুভূতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্য রচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ–উত্তর আমাদের নাটক সে আখ্যানের জীবনমথিত নাট্যভাষ্য রচনা করেছে বিচিত্র অনুষঙ্গে। তাতে মিশে আছে পূর্বপুরুষের দ্রোহ, দাহ, প্রতিবাদ।
স্বাধীনতার স্পর্শে পরিবর্তিত জীবনের অনুপুঙ্খ উচ্চারণ অসংকোচ চিত্তে উপস্থাপিত হয়েছে চট্টগ্রামের নাটকের মুকুরে । জীবনের রূঢ় বাস্তবতা যেমন তাতে প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি জীবনের বহুবিধ সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে আমাদের নাট্যকাররা। মুক্তিযুদ্ধ–উত্তর কালে মঞ্চ হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনের প্রত্যয় ও প্রত্যাশার বিশ্বস্ত প্রতিবিম্ব। জীবনের বিচিত্র রূপ ধরা দিয়েছে আমাদের মঞ্চের ক্যানভাসে। যে দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের যাপিত জীবন অতিবাহিত হয়, সে সময়ের জীবনবেদ, সময়ের সংকট ও সম্ভাবনা এবং নানামুখী ক্ষতকে উন্মোচনের মধ্য দিয়ে মুলত আমাদের সম্মিলিত সমাজজীবনই মঞ্চালোকে প্রতিফলিত হয়েছে।
আমাদের নাট্যাঙ্গনের যতটুকু অর্জন তার পুরো কৃতিত্ব গ্রুপ থিয়েটারের। সম্পূর্ণ প্রতিকূল বাস্তবতায় উন্মেষকালের স্বপ্নতাড়িত তরুণরা গ্রুপ থিয়েটারের আশ্রয়ে উন্মোচন করেছিল নাটকের একখন্ড বন্ধুর ভূমি। কালের বর্তমান প্রান্তে এসে তাকালে দেখা যায় সেখানে গড়ে উঠেছে শস্যপূর্ণ এক বিস্তৃত ফসলের মাঠ। সহস্র নাট্যপ্রেমিকের অজস্র দিবসের অক্লান্ত শ্রমে ঘামে প্রেমে সেখানে বেড়ে উঠেছে কাঙ্ক্ষিত ফলবান মহীরূহ। একটি ইতিবাচক, মানবিক এবং সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মানে আমরা বদ্ধ পরিকর। এর জন্য জীবনের বহুমাত্রিক বিকাশ প্রয়োজন। নাটক সেই শিল্প শক্তি– যেখানে উন্মোচিত হয় জীবন। নাটক সেই বিশ্বস্ত দর্পণ– যা আমাদের জীবনের অদেখা রূপকে প্রকাশ্যে তুলে ধরে। দর্শক সেখানে খুঁজে পায় নিজের অবয়ব বা জীবন স্বরূপ। তাই নিজেকে, অপরকে এবং সম্মিলিত জীবনকে চিনতে, জানতে ও বুঝতে গ্রুপ থিয়েটার এখনও বিশ্বস্ত শিল্পমাধ্যম।
বিগত পঞ্চাশ বছর চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটারের পতাকাতলে নাটকের বিপুল চর্চা হয়েছে। পুষ্প–পত্র–পল্লবে বিকশিত হয়েছে নাট্যপ্রাঙ্গণ। এখন একাধিক মঞ্চে পাদপ্রদীপের আলো জ্বলে। সেখানে শোনা যায় নাটকের মার্জিত সংলাপ। নতুন পথের সন্ধানে পরীক্ষা নিরীক্ষাও হয়েছে প্রচুর। কিন্তু, চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরা প্রচলিত গ্রুপ থিয়েটার নাট্যপদ্ধতি ছাড়া অন্যকোনো নাট্যকৌশলে কখনো আস্থা রাখেনি। গ্রুপ থিয়েটার এখনো আমাদের নাট্যাঙ্গনের অবিকল্প অহংকার। সৃজনশীল স্বপ্নবান তারুণ্যের বিশ্বস্ত ঠিকানা।
চট্টগ্রামের নাট্যঙ্গন বহুমাত্রিক সৃজন চিন্তনে সমৃদ্ধ। নাটকের আঙ্গিক ও বিষয় বস্তুতেও রয়েছে বিভিন্নতা। তবে, লক্ষণীয় বিষয় হলো– আমাদের নাট্যাঙ্গন কখনোই মজারুকে প্রাধান্য দেয়নি। আমাদের নাটক দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ সমাজ ও ব্যক্তির যাপিত জীবনের ছবি এঁকেছে। উন্মোচন করেছে কালের ক্ষত। সম্মিলিত প্রতিবাদের সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার হয়ে ভূমিকা রেখেছে দ্রোহে সংগ্রামে। উন্মেষকাল থেকেই– অঙ্গীকার, সংঘবদ্ধতা, স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতা আমাদের নাট্যাঙ্গনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আগামীর নাট্যকর্মীদেরও এসব শর্তহীনভাবে মেনে চলতে হবে। নতুবা নাটক পথ হারাবে, অথবা নখদন্তহীন কোমল প্রসাদন সামগ্রী হয়ে উঠবে।
আমরা সামন্তযুগ পার হয়ে এসেছি। সমাজ সভ্যতার পরিস্রুত প্রান্তে আজ আমাদের অবস্থান। আজকের নাটক কখনোই বিত্তবানের বৈঠকখানায় চিত্তসুখের উপকরণ হতে পারেনা। আমাদের নাটক আমাদের জীবনদর্পণ। এ দর্পনে প্রতিফলিত হবে আমাদের মুখ। যে জীবন আমরা অতিবাহিত করছি, যে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যাপন করছি আমাদের জীবন– সে সময় ও জীবন উঠে আসুক আমাদের নাটকে, মঞ্চে ও ময়দানে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে দাতাপ্রভূর রকমারি মনোহর প্রলোভন থেকে। নষ্টপূঁজির আহ্বান, কর্পোরেট কারসাজি যেন আমাদের বিভ্রান্ত না করে। নাটক হোক অভিনয়কর্মী ও দর্শকের পারস্পরিক চেনা বিনিময়ের বিশ্বস্ত মাধ্যম। নাটক থাকুক মঞ্চে, ময়দানে, মিলনায়তনে, প্রঙ্গনে। নাটক থাকুক সংঘবদ্ধ মানুষের সম্মিলিত চেতনায়। নাটক থাকুক আমাদের দ্রোহে, প্রতিবাদে, সংগ্রামে– আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত যৌথ উচ্চারণে।
চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার অনমনীয় তারুণ্যের অসংকোচ উচ্ছ্বাস। প্রতিস্বিক চেতনা ও চিহ্নসূত্র ধারন করে গড়ে উঠেছে এ নগরের নাট্যঙ্গন। এ অঙ্গন কোনো বৃহত্তর নগরের এক্সটেনশন কিংবা ব্যাকবেঞ্চ নয়। চট্টগ্রামের নাট্যঙ্গনের পরিচয় স্বতন্ত্র, সবদিক দিয়ে সমৃদ্ধ, নিজস্ব ভাবনায় পরিপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনের রয়েছে পথিকৃতের ভূমিকা। নিরব তপস্যার উপযুক্ত পরিবেশে এখানে প্রতিটি নাট্যকর্মী সমর্পিত। চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনের অন্বেষা ও অর্জন, নাট্যকর্মীদের স্বপ্ন ও অঙ্গীকার বিবেচনায় বলা যেতে পারে– আগামী দিনগুলোতে এ নগরের নাটক আরও বৃহত্তর পরিসরে বিচিত্র বিন্যাসে বিকশিত হবে। একদিন চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গন হয়ে উঠবে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার মূলস্রোত।
চট্টগ্রামের নাটক মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল কালখন্ডের উত্তাপস্নাত বিশ্বস্ত শিল্পকলা। বিগত পঞ্চাশ বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ছিল এ শিল্পমাধ্যমের মুলমন্ত্র। সে চেতনা এখনো পূর্ণমাত্রায় প্রবহমান।। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি শোষণমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদমুক্ত আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আমাদের পরম আরাধ্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চর্চিত আমাদের নাট্যচর্চা সে কঙ্ক্ষিত সমাজ বিনির্মাণের সহায়ক শক্তি হিসাবেই সতত সক্রিয়। ২৭ মার্চ বিশ্ব নাট্যদিবসে নাটকের সকল কর্মী, দর্শক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। নাটকের জয় হোক।