টেস্ট ক্রিকেটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তারা। নিজেদের মাঠে হারেনি টানা ১৭ টেস্ট। জিতেছে ৯টি সিরিজ। হোয়াইট ওয়াশ করেছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দলকে। সর্বশেষ ২০১২ সালে নিজেদের মাঠে হেরেছিল নিউজিল্যান্ড। উপ মহাদেশের দলগুলোর মধ্যে পাকিস্তান নিউজিল্যান্ডের মাটিতে সর্বশেষ জিতেছিল ২০১১ সালে। ভারত জিতেছিল ২০০৯ সালে আর শ্রীলঙ্কা জিতেছিল ২০০৬ সালে। নিউজ্যিলান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ সব মিলিয়ে খেলেছে ৩৩ ম্যাচ। জিতেনি একটিতেও। দেশে এবং নিউজিল্যান্ডে সব মিলিয়ে আগের ১৫ টেস্টের সবকটিতেই হার বাংলাদেশের। এমনিতেই নিউজিল্যান্ডের মাটিতে জেতা বিশ্বের যেকোনো দলের জন্য ক্রিকেটে সবচাইতে কঠিন কাজ। তার উপর এবারে নিউজিল্যান্ড সফর করা বাংলাদেশ দলটি ছিল একেবারেই তারুণ্য নির্ভর। নেই সাকিব-তামিমের মত দলের সেরা ক্রিকেটার। কিন্তু উদ্দীপ্ত একদল তরুণের চোখে মুখে ছিল ইতিহাস বদলানোর স্বপ্ন। হারানোর কিছু নেই কিন্তু পাওয়ার আছে অনেক কিছু; এমন মন্ত্রে উজ্জীবিত দলটি শেষ পর্যন্ত রচনা করেছে ইতিহাস।
শক্তি, সামর্থ্য, কন্ডিশন আর পরিসংখ্যান সবমিলিয়ে যোজন যোজন এগিয়ে থাকা নিউজিল্যান্ডকে আকাশ থেকে একেবারে মাটিতে নামিয়ে আনল বাংলাদেশের তরুণ দলটি। গত ২১ বছর ধরে যে স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলছিল টাইগার ক্রিকেটাররা, যে স্বপ্ন ছোঁয়ার কাছাকাছি গিয়েও শেষ পর্যন্ত ছোঁয়া হয়নি, স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় কাঁদতে হয়েছে বারবার, সে স্বপ্ন অবশেষে ধরা দিল। পরাক্রমশালী নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাটিতে হারিয়ে বাংলাদেশ রচনা করল ইতিহাস। নিউজ্যিলান্ডের মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের বে ওভালে বাংলাদেশ ৮ উইকেটে হারিয়েছে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডকে। আর এই জয়টিকে ভাবা হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচাইতে স্মরণীয় এবং ইতিহাস গড়া জয়।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যর্থতা। তারপর নিজেদের মাঠে পাকিস্তানের কাছে দুই সিরিজে হোয়াইট ওয়াশ। যেখানে আবার একটি টেস্ট ম্যাচ হেরেছে মাত্র দুই দিনে। সব মিলিয়ে পাহাড়সম চাপের নিচে ছিল টাইগার ক্রিকেটাররা। সংবাদ মাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সর্বত্র ছিল গেল গেল রব। ক্রিকেটার, নির্বাচক, বোর্ড পরিচালক, কোচিং স্টাফ সবার চাপের বোঝা যেন গিয়ে পড়েছিল ১১ জন বঙ্গ সার্দুলের কাঁধে। সে চাপে বারবার ভেঙ্গে পড়লেও এবার আর ভাঙ্গেনি। উল্টো মচকে দিয়েছে প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ডকে। গতকালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ ১৫ টেস্ট ম্যাচ জিতেছে। তবে কোন ম্যাচেই টানা পাঁচদিন ম্যাচের লাগাম টেনে রাখতে পারেনি। যা পেরেছে এই ম্যাচে নিউজ্যিলান্ডের বিপক্ষে। সেই প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশের হাতেই ছিল টেস্টের বাটন। প্রথম দিন থেকে উজ্জ্বলতা ছড়াতে থাকা ম্যাচের শেষটা রাঙ্গাল টাইগাররা অনন্য, অসাধারণ এক জয় দিয়ে।
জয়, শান্ত, লিটন, মোমিনুল। যাদের ব্যাটে কচু কাটা নিউজিল্যান্ডের পেসার সাউদি, বোল্ট, ওয়াগনার, জেমিসনরা। যাদের এক একজনের টেস্ট ক্যারিয়ার বাংলাদেশের সবার টেস্টের সমান। ইবাদত, শরীফুল, তাসকিনদের এক একটা আগুনের গোলা সামাল দিতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়েছে রস টেইলর, ল্যাথাম, ইয়ং, কনওয়েদের মত বিশ্ব সেরা ব্যাটসম্যানদের। বিশেষ করে একজন ইবাদত হোসেন যেন দেখিয়ে দিয়েছে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বা কন্ডিশনে বল করার কৌশলটা তারা রপ্ত করে ফেলেছে। নিউজিল্যান্ডের উইকেট বরাবরই পেসারদের অকৃত্রিম বন্ধু। তাই বলে বাংলাদেশের ভরসার সবচাইতে বড় জায়গা স্পিনও কেন দর্শক হয়ে থাকবেন। মেহেদী হাসান মিরাজ যেন দেখিয়ে দিলেন ঘাসের উপর লাটিম ঘুরাতে সিদ্ধ হস্ত তিনিও।
সাদা পোশাক আর লাল বলের ক্রিকেটে বরাবরই বিবর্ণ বাংলাদেশ। কিন্তু এবারের নিউজিল্যান্ড সফরে সবুজের চাদরে ঢাকা মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের সবুজ গালিচাকে টাইগাররা বিবর্ণ করে দিল নিজেদের উজ্জ্বলতা দিয়ে। টেস্টের এক একটি দিন পার হয়েছে তো উজ্জ্বলতা বেড়েছে বাংলাদেশের। বিবর্ণ হয়েছে স্বাগতিকদের। গত ২১ বছর ধরে যে প্রতাপে টাইগারদের শাসন কেরছে কিউইরা সে শাসন যেন একইভাবে ফিরিয়ে দিল এই টেস্টে। প্রথম টেস্টের লাগাম টেনে ধরে বিজয়ী বীর টাইগারদের হাতে এখন সিরিজেরই লাগাম। তাই প্রত্যাশা এখন সিরিজ জেতার। ইতিহাসের শেষ অধ্যায়টি রচনা করার।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে জয়ের গন্ধটা পাচ্ছিল চতুর্থ দিন শেষে। মাত্র ১৭ রানে এগিয়ে থাকা নিউজিল্যান্ড তখন হারিয়ে বসেছিল ৫ উইকেট। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অভিজ্ঞ রস টেইলর। ম্যাচ জয়ের সে গন্ধকে সঙ্গী করে শেষ দিনে মাঠে নামা টাইগার বোলার ইবাদত উপড়ে ফেলেন রস টেইলর বাধা দিনের কেবল দ্বিতীয় ওভারেই। ৪০ রান করা টেইলরের স্টাম্প উপড়ে উৎসব শুরুর ক্ষণ গণনা শুরু করে দেন ইবাদত। নিজের পরের ওভারে জেমিসনকে ফিরিয়ে তুলে নেন ষষ্ঠ উইকেট। এরপর বাকি কাজটা সেরেছেন তাসকিন। তুলে নিয়েছেন শেষ দুই উইকেট। নিউজিল্যান্ড থামে ১৬৯ রানে। যা সচরাচর বাংলাদেশ থামতো কিউইদের সামনে। এবার যেন গনেশটা উল্টে দিলেন ইবাদত-তাসকিনরা। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত ৫ বা বেশি উইকেট নিয়েছেন ইবাদত। প্রথম ইনিংসের এক উইকেটসহ তার সংগ্রহ ৭ উইকেট। আর তাসকিন নিয়েছেন তিন উইকেট। বাংলাদেশের সামনে ইতিহাস রচনার জন্য তখন দরকার কেবল ৪০ রানের। দ্বিতীয় ওভারে ফিরেছেন সাদমান। কিন্তু তাতেও যেন হতাশার লেশ মাত্র নেই টাইগার শিবিরে। থাকবেইবা কেন, ঐতিহাসিক জয় যে কেবলই হাত মেলানো দূরত্বে। ১৭ রান করে চলে গেলেন শান্তও। তখনো হতাশার চাইতে আনন্দটা বেশি টাইগারদের। কারণ আর ৬ রান পরেই যে বাধ ভাঙ্গা উল্লাসে মাতার ক্ষণ অপেক্ষা করছে। মুশফিককে নিয়ে অধিনায়ক মোমিনুল বাংলাদেশ দলকে পৌছে দিলেন ইতিহাসের নীল গগনে। কারণ এই জয়টা যে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সোনালী ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মত জয়।