২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, তখন বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৮২ হাজার। এ বেকারদের মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর সংখ্যা ৭ লাখ ৯৯ হাজার। এর মানে হলো মোট বেকারের প্রায় ৩১ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। দেশের মোট বেকারের প্রতি ৩ জনের ১ জন বিএ–এমএ পাস করেও চাকরি পাচ্ছেন না।
শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পাস বেকার তরুণ–তরুণীদের সংখ্যা যোগ করলে চিত্রটি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। দেশের মোট বেকারের ৫১ শতাংশই কমপক্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পাস। আরও পেছনের দিকে কোভিডের আগে ২০১৬–১৭ সালের দিকে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকার পরিস্থিতি কেমন ছিল তা দেখা যেতে পারে। ২০১৭ সালে শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, তখন দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এ বেকার তরুণ গোষ্ঠীর মধ্যে ৪ লাখ ৫ হাজারের চাকরি প্রত্যাশীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল কমপক্ষে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪ লাখ। তবে শিক্ষার সুযোগ পাননি কিংবা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছেন, এমন তরুণ–তরুণীদের মধ্যে বেকারের হার কম। কারণ তারা যে কোনো ধরনের কাজ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। দেখা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষা লাভ করে একজন তরুণ কিংবা তরুণী এমন ধরনের মানসিকতায় আচ্ছন্ন হন, যার ফলে তারা যে কোনো কাজ করতে চান না। তারা মনে করেন কাজ করতে গিয়ে তাদের হাত–পা ময়লা হবে, যা তাদের অর্জিত ডিগ্রির সঙ্গে যায় না।
অন্যদিকে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যসূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ কর্মবাজারে যুক্ত হন। তাদের মধ্যে দেশীয় বাজারে কর্মসংস্থান হয় ১২ থেকে ১৩ লাখের এবং ৮ থেকে ৯ লাখ মানুষ যায় প্রবাসে। বাকিদের কাজের কোনো সুযোগ নেই। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বুরে্যার (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালে কাজের প্রত্যাশায় গড়ে প্রতিঘণ্টায় দেড়শ’ বাংলাদেশী দেশ ছেড়েছেন। প্রতিবছর বাংলাদেশীদের জন্য যত কর্মসংস্থান হচ্ছে, তার এক–তৃতীয়াংশই হচ্ছে প্রবাসে। স্বল্প শিক্ষিত তরুণদের প্রধান গন্তব্য মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। দেশে শোভন কাজ না পেয়ে উন্নত জীবনযাপনের প্রত্যাশায় অনেক বাংলাদেশী তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হতে চেষ্টা করছেন। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় বিদেশের কারাগারে বন্দি বাংলাদেশীর সংখ্যাও কয়েক লাখ।
দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ শতাংশের মতো হলেও মোট জনশক্তির প্রায় এক–তৃতীয়াংশই বেকার। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, কিংবা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে লক্ষাধিক, যাদের বেশিরভাগের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এমনিতেই বিশ্ব মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বেই কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান যে হারে বাড়ছিল, তা হ্রাস পেয়েছে নানা কারণে। তাই অনেকে শ্রম বেচতে বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অস্থিরতার কুফল যেসব দেশ ভোগ করছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। সারা বিশ্বে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি নাগরিক কর্মসংস্থানের কারণে বসবাস করছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায়ই উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। তাই বলা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ কোনোটাই মূলত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে বৃহৎ এ জনগোষ্ঠী সম্পদ নয়, রাষ্ট্রের বোঝা হিসেবেই ভাবা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নতুন কর্মপরিবেশের উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরিও আবশ্যক। দেশে প্রতিবছর নতুন নতুন যে জনশক্তি যুক্ত হচ্ছে, তাদের যথাযথভাবে কর্মদক্ষ করে কাজে লাগাতে পারলে ভবিষ্যৎ নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নবতর অধ্যায় রচিত হবে।