পৃথিবীতে এখনো ধর্মের সংখ্যা ৪০০০, মতান্তরে ৪৩০০। তবে ধীরে ধীরে বহু ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আজকের আমেরিকার যাত্রা শুরু ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। ১৩টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে দেশটির যাত্রা শুরু এবং বর্তমানে এর অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ৫০। এটি পৃথিবীর সব’চে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। সব’চে সামরিক ক্ষমতাধর। সব’চে বেশি ধর্ম, জাতি ও বর্ণের বসবাস এই ভূ–খণ্ডে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার একবারে শীর্ষ পর্যায়ে। ১৭৮৯ সালে সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গোটা পৃথিবীর কাছে এক বিরল দৃষ্টান্ত। বাস্তবতা হলো এক অদৃশ্য শক্তি গোটা পৃথিবীর অভিবাসীদের চুম্বকের মতো টানছে তো টানছে।
মাত্র আড়াইশো বছরের পথচলায় এরকম ঈর্ষণীয় ভিত্তি এসেছে জর্জ ওয়াশিংটনের হাত ধরে। ভার্জিনিয়ার ধনীর দুলাল হলেও জীবন শুরু হয়েছিল পরিশ্রমী জরীপ কাজের মধ্য দিয়ে। সরকারি আমিন হিসেবে কাজ করার সময় গভর্ণর ডিনউইডির নজরে আসেন এবং সেনা বিভাগে কমিশন লাভ করেন। এর পরের ইতিহাস বিদ্রোহ, মিলিশিয়া বাহিনী গঠন, ফরাসী ও ভারতীয় বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সশ্রস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার কাহিনি। ১৭৫৩ সালে ফরাসী বাহিনী ও ভারতের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনী ওহাইও উপকূল দখল করলে মেজর ওয়াশিংটনকে যুদ্ধে পাঠানো হয়। দীর্ঘ ৭ বছর যুদ্ধের পর ওহাইও দ্বীপপুঞ্জকে ফরাসী ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী থেকে দখল মুক্ত করা হয়।
এরপরই শুরু হয় আসল লড়াই। সরকারি চাকরি ত্যাগ করে নেমে গেলেন আমেরিকাকে স্বাধীন করার সশস্ত্র লড়াইয়ে। সাফল্য আসতে থাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো একের পর এক বিজয়ের মধ্য দিয়ে। ১৭৭৫ সালের ১৪ জুন মিলিশিয়া বাহিনীকে কন্টিনেন্টাল আর্মিতে উন্নীত করা হয় এবং ম্যাচাচুয়েটসের বিপ্লবী নেতা জন এডামস পূর্ণ জেনারেল মর্যাদায় ওয়াশিংটনকে সর্বাধিনায়ক নিয়ে দেন। ২৩ আগষ্ট বৃটিশ সরকার রাজদ্রোহী হিসাবে বিচারের ঘোষণা দেয়। তিনিও পাল্টা বৃটিশ পার্লামেন্টের অস্বিত্ব অস্বীকার করেন। তাঁর কন্টিনেন্টাল বাহিনীর হাতে বোস্টনের পরাজয়ের পর বৃটিশ বুঝে নেয় আমেরিকায় তাদের দখলদারিত্ব পতনের মুখে। সেদিনকার বিশ্বশাসক বৃটিশ ঔদ্ধত্যকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে ৪ জুলাই ১৭৭৬ ওয়াশিংটন আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে পরিগণিত হয়েছেন কিংবদন্তী নায়কে।
আজকের আমেরিকার ভিত্তি ১৭ সেপ্টেম্বর ১৭৮৭ সালে প্রণীত সংবিধান। প্রস্তাবনাটি নিম্নরূপ ‘We are people of the United States in order to form a more perfect union, establish Justice, insure domestic tranquility, provide for the common defense।’
এই প্রথম পৃথিবী দেখল একটি রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করেছে ন্যায় ভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। পুরোপুরি ধর্ম সামন্ততন্ত্র রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রকে দূরে ঠেলে দিয়ে। বলা হয়ে থাকে জর্জ ওয়াশিংটনের ধর্মীয় চিন্তা মার্কিন সংবিধান প্রণয়নে গভীর ছাপ রেখেছে। জন্মসূত্রে খৃষ্টান হলেও ওয়াশিংটন কোনও ধর্মেই বিশ্বাসী ছিলেন না। বৃটিশ দার্শনিক টমাস পেইন ১৭৯৪ সালে প্রকাশিত ‘দ্য এজ অফ রিজন’ লিখে বিশ্বের মুক্তমনা মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড সাড়া জাগিয়েছেন। ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লব ইউরোপীয় মননে মুক্ত চিন্তার প্রবাহ সৃষ্টি করে। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে ইউরোপীয় শিল্পী সাহিত্যিক বিজ্ঞানীদের বৃহৎ অংশ ধর্মকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেন। পঞ্চাশ ষাট এবং সত্তরের দশকে টমাস পেইন তাঁর অনুসারী নিয়ে উবরংস দর্শন প্রচার শুরু করেন। এই দর্শনের মূল কথা হল ঈশ্বর নামক অদৃশ্য মহাশক্তি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন। তবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, প্রাণ, জীব ও বস্তুজগতে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না। ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই চলে বা নিয়ন্ত্রিত হয় পদার্থ বিদ্যার নিজস্ব নিয়মে। বেদ, তোরাহ, তানাখ, গীতা, বাইবেল, কোরআন সহ কোন ধর্মগ্রন্থই ঈশ্বরের প্রেরিত বক্তব্য নয়। এগুলোকে ঈশ্বরের অলঙ্ঘনীয় বিধি বিধান না ভেবে বড়জোর সাহিত্যের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। পৃথিবীতে অলৌকিক কোনও বিষয় নেই। যা ঘটে তা নিশ্চিতভাবে কোনও না কোনও বিষয়ের কার্য–কারণ বিক্রিয়ার ফসল মাত্র। কপালগুনে বা দৈবক্রমে কোনও ঘটনাকে অলৌকিকত্ব বা অদৃশ্য শক্তির কারসাজি আখ্যা দিতে তাঁরা নারাজ ছিলেন। কন্টিনেন্টাল আর্মির নেতৃত্ব দেয়ার সময় থেকে ওয়াশিংটন এসব উবরংস মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
অষ্টাদশ শতকের সত্তর দশকে উবরংস মতবাদ আমেরিকার প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো ধর্ম অলৌকিকতা বিচ্ছিন্ন প্রগতিশীল একটি আমেরিকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। জর্জ ওয়াশিংটন সহ প্রচুর যোদ্ধা ও রাজনীতিক নিজেদের ঈশ্বরবাদী বলে পরিচয় দিতে থাকেন।
উবরংস দর্শন জাপানের সিন্তো ধর্মের অনেকটা কাছাকাছি একটি প্রকৃতিবাদী মতবাদ। কিন্তু সিন্তো ধর্মের মতো প্রকৃতি পূজারী নহে। প্রকৃতি কারো পূজার জন্য অপেক্ষা করে না এবং পূজা করুক বা নাই করুক পদার্থবিদ্যার নিজস্ব নিয়মে প্রকৃতিতে যা ঘটনার তা ঘটবেই। প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর এবং তিনি এক ও অদ্বিতীয়। কোনওরূপ প্রার্থনা ঈশ্বর প্রত্যাশা করেন না এবং প্রার্থনায় তিনি পুলকিত হন না বা কারো প্রার্থনায় তিনি কারো অপরাধ মার্জনা করেন না। মনুষ্য প্রজাতির প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মের ফলাফল প্রকৃতির তরফ থেকেই ভোগ করতে বাধ্য। প্রায় আড়াইশো বছর ধরে উবরংস দর্শন নিয়ে আমেরিকা দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে মহাশূন্যে। ক্ষীপ্রতার সাথে রহস্য সন্ধানে আছে বন জঙ্গল সমুদ্র তলদেশ ও ভূ–অভ্যন্তরে। মনুষ্য মৎস্য পশু কীট পতঙ্গ সহ প্রাণের উৎপত্তি ঈশ্বর প্রদত্ত নয় বরং পৃথিবীর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক রাসায়নিক বিক্রিয়াগত অবস্থানের কারণে প্রাণের উৎপত্তি বিকাশ এবং বিবর্তন। চার্লস ডারউইন এর আগেই উবরংস অনুসারীদের মনে ক্রিয়াশীল ছিল। তবে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির ব্যাপারে বিজ্ঞানের বক্তব্যের সাথে ঈশ্বরবাদী দর্শনের পুরোপুরি মিল নেই।
সহজ কথায় বিজ্ঞানীদের বক্তব্য হলো ‘বিগ ব্যাং’ এর ফলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শুরু এবং অব্যাহত প্রসারের ফলে বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি। ঈশ্বরবাদী দর্শন ‘বিগ ব্যাং তত্ত্বকে’ স্বীকার করেন না এবং তারা মনে করেন ঈশ্বর তার মতো করে বর্তমান বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন এবং যখন ইচ্ছে তখন ধ্বংস করবেন।
দার্শনিক বিতর্ক যাই’ই হোক, আজকের আমেরিকা জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোনও শাখা নেই যেখানে খুঁজছে না প্রাণের রহস্য, প্রকৃতির রহস্য। লক্ষ্য একটাই মানবজাতির ভবিষ্যতকে উন্নত থেকে উন্নততর করা। পৃথিবীব্যাপী মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্রকে ছড়িয়ে দেয়া আমেরিকার বহু সমালোচনা করা যাবে। নিজের চোখে দেখে এলাম দেশটি প্রগতির এক অতন্দ্র প্রহরী। এর জন্মদাতা ওয়াশিংটন এবং এর তাত্ত্বিক ভিত্তি হলো উবরংস বা ঈশ্বরবাদ।
লেখক : প্রাবন্ধিক; আইনজীবী –আপীল বিভাগ।