বেশ কিছুদিন থেকে সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের লাগামহীনতার কথা। মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। বিভিন্ন সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ানোর কথাও বারংবার উঠে এসেছে এসব প্রতিবেদনে। এত এত সংবাদের পরও সিন্ডিকেট ভাঙা দূরে থাক, বরঞ্চ সিন্ডিকেট যেন দিন দিন বটগাছে রূপ নিচ্ছে। একদিকে সাধারণ মানুষের হাহুতাশ বাড়ছে, অন্যদিকে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তোষও বাড়ছে সমানে। মাঝখানে লাভবান হচ্ছে শুধুই অসাধু সিন্ডিকেটগুলো।
আওয়ামী লীগের সরকার যখন ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে পেরেছিল। তাতে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্টও ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে সরকার গঠনের পর থেকে আজ অবধি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যে বাড়া শুরু হয়েছে, তা যেন আর থামছেই না।
বিগত কয়েক বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাল ডাল পেঁয়াজ রসুন তেলসহ ইত্যাদি নিত্যপণ্যের দাম আগের দাম থেকে বেড়ে দ্বিগুণ থেকে চারগুণ পর্যন্ত হয়েছে। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরই আন্তরিক মানুষের সহজ সাবলীল সুন্দর জীবন যাপনের প্রতি। কিন্তু একটি অসাধু চক্র বারংবার সরকারকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালায়। এই কাজে অসাধু চক্রটিকে অধিকাংশে সফলও বলা চলে। তাই সরকারের উচিত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই চক্রটির মূলোৎপাটন করে শিকড় উপড়ে ফেলা।
সংবাদ মাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, যে চিকন চালের দাম ২০০৯ সালে প্রতি কেজি ৩৫–৩৬ টাকা ছিল, সে চালের দাম বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫–৯০ টাকা। মোটা চালের দাম ছিল ২২–২৩ টাকা, বর্তমানে দাম বেড়ে ৫৫–৬৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ডালের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০০৯ সালে এক কেজি দেশি মোটা মসুর ডালের দাম ছিল ৫০–৬০ টাকা, বর্তমানে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি ১০০–১১০ টাকা। চিকন মসুর ডালের দাম ছিল ২০০৯ সালে ৭০–৮০ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪০–১৫০ টাকা। ২০০৯ সালে এক কেজি আটার দাম ছিল ২৭–২৯ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫–৬০ টাকা। ২০০৯ সালে এক কেজি ময়দার দাম ছিল ৩৫–৩৭ টাকা, বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫–৭০ টাকা। পেঁয়াজ ২০০৯ সালে এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০–৪৪ টাকা, বর্তমানে বেড়ে সে পেঁয়াজ কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৮৫–৯০ টাকায়। আর আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৮–৩৪ টাকা, বর্তমানে সে পেঁয়াজের দাম বেড়ে ১২০–১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এরপরও মাঝেমধ্যে পেঁয়াজের বাজার অস্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।
রসুন এক কেজি রসুনের দাম ছিল ৮০–৮৫ টাকা। বর্তমান বাজারে তা বেড়ে কেজি ২১০–২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সয়াবিন তেলের দাম বর্তমানে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০০৯ সালে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০–৭৩ টাকা, বর্তমানে সেই তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৫–১৮০ টাকায়। যদিও সরকার বলছে কেজি ১৬৮ টাকার ওপরে যারা দাম নিবে সেসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। চিনি ২০০৯ সালে আমদানিকৃত এক কেজি চিনির দাম ছিল ৫২–৫৪ টাকা, বর্তমানে সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়।
মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ সবার কমন সবজি হিসেবে যে খাবার বিবেচিত সেই আলুর দামও কয়েকগুণ বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০–৪০ টাকায়। তবে কিছুদিন পর পর আলুর দামও বেড়ে যায় লাগামহীনভাবে।
রহমতের পয়গাম নিয়ে শুরু হলো পবিত্র রমজান। আরবসহ সারা বিশ্বে পবিত্র রমজানকে কেন্দ্র করে রোজাদারদের সম্মানে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ৫০–৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেন। বিভিন্ন দেশে রোজাদারদের ইফতার–সাহরি খাওয়ানো হয় বিনামূল্যে নেকির উদ্দেশ্যে। আর তার ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। দেশে রমজান এলেই সবকিছুর দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রমজানে যেসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে রোজাদারদের জিম্মি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় তারাও অধিকাংশ মুসলমান। এহেন গর্হিত অনৈসলামিক কাজ হতে বিরত থাকা উচিত এসব মুসলমান ব্যবসায়ীদের।
সরকারের উচিত সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে অতি দ্রুত সিন্ডিকেটগুলো ভেঙে পণ্য সরবরাহ বাড়ানো, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা, রমজান রিলেটেড পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো, মজুদদারী কঠোরভাবে দমন করা, বাজার মনিটরিং জোরদার করা, অসম প্রতিযোগিতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। তাছাড়া অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়াসহ সিন্ডিকেটে জড়িতদের লাইসেন্স বাতিল করে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে জেল জরিমানার বিধান নিশ্চিত করতে পারলেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমে জনমনে স্বস্তি আসতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক