ঊনো ভাতে দুনো বল
ঘটনা কি? আমাদের এই হোটেলের সামনের বাগান পেরিয়ে যে সদর রাস্তা তার ওপাশে গা ভর্তি ঝলমলে নানান রঙয়ের আলোর গয়না নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংটা কি মসজিদ নাকি? চায়নায় মুসলমান আছে কিছু এবং মসজিদও আছে তা জানি, কিন্তু তা এক্কেবারে বেইজিং শহরের ডাউনটাউন এলাকায় থাকবে তা তো ভাবিনি। আর এ তো এক্কেবারে বিরাট আকারের বহুতল মসজিদ! ভাবতে ভাবতে কাচের গা নাক লাগিয়ে নানান ডিগ্রিতে মাথা আর চোখ ঘুরিয়ে ঐটি জরিপ করতে করতে কেন জানি প্রত্যয় হলো, আলোকশোভিত চমৎকার স্থাপত্যের এই বহুতল দালান আর যাই হউক মসজিদ হতে পারে না। আসলে এটার ছাদের উপরের একাধিক গম্বুজ আকৃতির ডোম থাকাতেই, প্রথমেই ভির্মি খেয়েছিলাম এই ভেবে যে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে বুঝি বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের কোন চাচাতো খালাতো ভাই বুঝি। বিলক্ষণ যদিও জানি যে গম্বুজ দিয়ে শুধু আমাদের দেশেই ইদানিং মসজিদ বানানো হয়। ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি এশিয়ারও নানান দেশের সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস আদালতের বিল্ডিংগুলো অনেক আগে থেকেই তো গম্বুজশোভিত। আর বানানোও হয়েছিল সেগুলোর বেশিরভাগই ১৪শ থেকে ১৬শ শতকের দিকে। আরে খোদ তাজমহলেই তো আছে গম্বুজ, আছে আবার আমাদেরই হাইকোর্ট বিল্ডিং এও।
সে যাক ভালভাবে আবারো এটিকে চোখ জরিপ করার পর অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেল যে, এটা মসজিদ বা কোনধরনেরই উপাসনালয় না। তবে এটা যে কী তাও বুঝতে পারছি না।
অনলাইনে হোটেলের বর্ণনা পড়তে গিয়ে জায়গাটা বেইজিং এর ডাউন টাউন বলেই পড়েছিলাম। ঠিক এ সময়েই টুং টাং করে রুমের বেল বেজে উঠতেই পর্দার ওপাশ থেকে মনোযোগ রুমের ভেতর ফিরতেই ঘুরে হাঁটা ধরলাম দরজার দিকে। এদিকে আমাকে অনুসরণ করা, লাজু আর হেলেনের খাবার এলো কি না যুগপৎ এমত উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসায় পরিষ্কার হল বেচারাদের পেট যে খিদেয় চোঁ চোঁ করছে। উত্তরে দরজার দিকে এগুতে এগুতে জানালাম যে সে সম্ভাবনাই সুপ্রচুর।
দরজা খুলতেই হোটেলের ধোপদুরস্ত পোশাকপড়া ফিটফাট এক চায়নাম্যানকে, একটা ট্রলি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ট্রলির উপরে চোখে পড়ল একটু আগে দেখা ঐ বিল্ডিংটির গম্বুজের মতোই ছোট ছোট তিনটা ঝকঝকে স্টিলের গম্বুজ। যার উপরে চমৎকার ভাবে অজানা কোন ফুলের আকৃতিতে ভাঁজ করে রাখা আছে ধব ধবে সাদা ন্যাপকিন। না বোজার কোন কারণ নেই যে, ট্রলির উপরে থাকা ঐ স্টিলের গম্বুজের নিচেই সাজিয়ে রাখা আছে , নাসিং গোরেং এর ডিসগুলো।
প্রথমে দরজা খুলতেই চায়নাম্যানের সাথে যখন চোখাচোখি হয়েছিল, একটু মাথা ঝুঁকিয়ে গুড ইভিনিং বলে বুকের কাছে হাত ভাঁজ করে সে অত্যন্ত তমিজের সাথে দাঁড়িয়েছিল। এমুহূর্তে ফের চোখাচোখি হতেই জিজ্ঞেস করলো ঢুকতে পারে কী না সে কক্ষাভ্যন্তরে? জবাবে প্রথমে রুমের সকলের উদ্দেশ্যে কিছুটা উঁচু গলায় জানালাম যে খাবার এসে গেছে। এক্ষুণি খাবার নিয়ে ঢুকবেন কক্ষে রুমসার্ভিসের লোক। বলে রাখলাম তা যাতে রুমের নারীসদস্যরা, রুমে হঠাৎ কোন অপরিচিত পুরুষের উপস্থিতিতে অপ্রস্তুত বোধ না করেন । যদিও তাদের এমনিতেই তা বোঝা উচিৎ যে, যে কোন মুহূর্তেই খাবার নিয়ে রুমসার্ভিসের লোক আসার কথা। আর একটু আগে বেজে ওঠা বেল সে সঙ্কেতই দিয়েছে, তারপরও ঝুঁকি নিলাম না আর কি? ভেতরের সবার দৃষ্টি না হলেও কর্ণাকর্ষণ করার সাথে সাথেই দরজার মুখ থেকে নিজেকে একপাশে সরিয়ে, রুমসার্ভিসের চায়নাম্যানের তমিজের সাথে পাল্লা দিয়ে বিগলিতভাবে হাত দিয়ে ভেতরে আসার জন্য ইঙ্গিত করার সাথে মুখেও বললাম অবশ্যই, আসুন আসুন। ভেতরে আসতে আজ্ঞা হউক আপনার।
ট্রলিটি রুমের ভেতরে ঠেলে বিছানার কাছ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে, পেছন ফিরে চায়নাম্যান তখনো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দিকে তাকাতেই বুঝলাম, জানতে চাইছে সে কোথায় সাজাতে হবে ট্রলিতে করে আনা এই রাতের খাবারের পসরা? এ খাবার সাজানোর জন্য দুটো টেবিল আছে রুমে, যার একটা হলো বিছানার পায়ের দিক থেকে মোটামুটি ২/৩ ফুট ডানে পেটে রাখা ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করার উঁচু টেবিলটা।আরেকটা হলো একদম রুমের অন্দরে জানালার পাশের সোফার সামনে রাখা নিচু গোল টি টেবিল টা। অবশ্য এ দুটো টেবিলের কোনটার ধারণক্ষমতা বলছে, এই ডিশগুলোর সবগুলোরই জায়গা হবে না কোন একটাতেই। রাখতে হবে ভাগযোগ করেই। তবে এ ব্যাপারে নিজে সিদ্ধান্ত নেবার ঝুঁকি না নিয়ে গলা উঁচিয়ে, লাজুকে সে ভার দিতেই সে বলল-‘ঠিক আছে, ওখানেই থাকুক। আমরা নিয়ে নেব।ওর আর ভেতরে ঢোকার দরকার নাই।’ তথাস্তু বলে, তাই চায়নাম্যানকে বললাম যে ধন্যবাদ, তোমার আর কষ্ট করার দরকার নাই। বাকিটা সামলে নেব আমরা। আমার বলা কথাকটির সবই তার কর্ণগোচর হলেও, তার মর্মবাণী কতোটা তার মর্মে পৌঁছেছে তা জানি না, তবে তার দেহভঙ্গির সাথে মুখভঙ্গি দেখে বুঝলাম মূলকথা যা বোঝার, বুঝে গেছে সে তা। অতএব নিচু হয়ে ঐ ট্রলির দ্বিতীয় তাকে রাখা রেঙিনের কাভারবন্দি খাবারের বিলটা ফের অত্যন্ত তমিজের সাথে আমার হাতে হস্তান্তর করে আবারো সে আধা কুর্নিশের মত ঝুঁকালো মাথা।
বিলের দিকে চোখ বুলিয়ে, নিজের অজান্তেই বুক পকেটের কাছে হাতড়াচ্ছি হাত যখন কলমের খোঁজে, চায়নাম্যান দ্রুত তার এপ্রনের পকেট থেকে কলম বের করে ওটার ক্যাপ খুলে দিলেন তুলে হাতে। খাপখোলা তলোয়ারের মতো ক্যাপখোলা কলম হাতে পেতেই বিলম্ব না করে, খস খস করে রুম নম্বর লিখে সই করে তা ফেরত দিলাম। অর্ডার যেহেতু খুবই সোজাসাপ্টা, একবার চোখ বুলিয়েই বুঝে গেছি ঘাপলা বা ভুল নেই কোন তাতে। “এনজয় ইউর মিল” বলে অতঃপর চায়নাম্যান রুম থেকে নিষ্ক্রান্ত হতেই, দরজা টেনে বন্ধ করে নিজে এসে সেই ট্রলির পেছনে দাঁড়িয়ে, পুত্রদের ডাকার জন্য সামনে তাকাতেই দেখি, দু জোড়া চোখ ওদের তখনো আটকে আছে হাতযন্ত্রের পর্দাতেই। মনে হচ্ছে তারা টেরই পায়নি যে এরই মধ্যে হাজির হয়েছে ঘরে রাতের খাবার! ততোক্ষণে বাঁ দিকে বিছানার মাথার দিকে বসে থাকা লাজু উঠে এসে ট্রলি থেকে একটা স্টিলের গম্বুজ দিয়ে ঢাকা খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে, আরেকটা আমাকে নিতে বলে এগুলো পুত্রদের সোফার দিকে, যার সামনেই আছে গোল মতো নিচু সোফা টেবিলটা। দু জনেই প্রায় একই সাথে খাবারের ট্রে দুটো রেখে, আমি যখন পুত্রদের তাড়া দিতে ব্যস্ত খাবার খেতে আসার জন্য,ততোক্ষণে লাজু একটা ট্রে র উপরের গম্বুজ তুলেই কিছুটা আর্তনাদ করে বলে উঠলো -‘খাবার তো অনেক কম দেখছি! এতে তো হবে না আমাদের সবার! এতো কম দিল কেন খাবার এরা? কুনমিং এর হোটেলে তো যে কোন খাবারের অর্ডারের সাথে, বেশ অনেকগুলো রুটি আর মাখনও দিত। এরা তো তাও দেয় নি!’
গম্বুজহীন ট্রে’র উপরে নজর পড়তেই প্লেটের উপরে থাকা মাঝারি এক বাটি পরিমাণ বাদামি মসলা আর নানা সব্জি ও মুরগির মাংসের টুকরো মেশানো ভাতের উপর একটা আস্ত পোঁচ করা ডিম চমৎকার ভাবে সাজিয়ে পরিবেশন করা সালাদসহ নাসিগোরেং এর পরিমাণ দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, হ্যাঁ, এতে একজনের বেশি ভাগ বসানো চলবে না। তার মানে হলো কুনমিং এর হোটেলের হিসাবে এখানে পাঁচজনের জন্য তিনটি ডিশের অর্ডার করায় তা কম হয়ে গেছে। এদিকে এমুহূর্তেও রুমের মধ্যে কি ঘটছে সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করা পুত্রদ্বয়কে তখনো তাদের হাতযন্ত্রে মগ্ন থাকতে দেখে লাজু ধমকে উঠতেই, হাতযন্ত্র দ্রুত সোফায় রেখে দুজনেই তাকাল আমার দিকে; যার মানে একটাই, এই যে বললাম আমি একটু আগে দীপ্র কে, আরো দুটো খাবারের অর্ডার করতে, বা তার আগে যা যা ঘটেছে রুমে, তার কোন কিছুই কানে যায় নি ওদের। অতএব ফের বললাম দীপ্রকে তার করণীয়।
সে মোতাবেক দীপ্র বিছানার পাশে রাখা ফোনের দিকে এগুচ্ছে যখন, তখনই হেলেন খাবারের দিকে নজর দিয়ে বলল, ‘না না, দুইটা খাবারের অর্ডার দেয়ার দরকার নাই। একটার অর্ডার করলেই হবে। এই প্লেটে যতোটা খাবার দেখছি তাতে, আমার আর দীপ্রর হয়ে যাবে ভালভাবেই। কি বল মিও দেখো তো!’
ফুপ্পির কথার জবাবে খাবারের দিকে চোখজরিপ করে দীপ্রও সায় দিল তার কথায়। আসলে হেলেন আর দীপ্র হলো যাকে বলে স্বল্পাহারী। অতএব এই এক প্লেটে তাদের হয়ে গেলে যেতেও পারে। কিন্তু অন্তত আমরা চার ভেতো বাঙালি সারাদিন তো, ভাতের দেখা পাইনি বললেই চলে। পুত্রদের মধ্যে দীপ্রর ভাবেসাবে কখনো মনে হয়নি যে সে ভেতো বাঙালি । হালে ঢাকায় গড়ে উঠা রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতির কারণে চারদিকে তো আজকাল নানান জাতের খাবারের ছড়াছড়ি। আর খায়ও ওরা ওসব মহানন্দে। তবে যতই বাইরের খাবার খাক না, কেন অভ্র ঘুমাবার আগে ঠিকই ভাত খায়। সে হিসাবে বলতে হয় এ কক্ষে উপস্থিত আমরা চারভেতো বাঙালি, অভুক্তই ছিলাম মোটামুটি সারাদিন । সেক্ষেত্রে এ মুহূর্তে ‘ঊনো ভাতে দু’নো বল, অতি ভাতে রসাতল’ বলে যে প্রাচীন প্রবাদ আছে আমাদের, তাতে আস্থা না রাখাই উত্তম । তার উপর আগামিকাল বেইজিংহিমে সারাদিন ঘুরতে হবে সবার। অতএব ফের দীপ্র কে দুটো খাবারের অর্ডারের তাড়া দিতেই এবার লাজুও বলে উঠল -‘না না, আরো দুটো খাবারের অর্ডার দেয়ার কোন দরকার নেই।’
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক