হাসিমুখের জয় সর্বত্রই
নাহ, কপাল অতো খারাপ মনে হলো না এবার আর এ সন্ধ্যায়। হোটেলে ঢোকার স্বয়ংক্রিয় সেই বৃত্তাকার মূল প্রবেশপথটির পাশের ছোট্ট দরজাটি আবারো খুলে যেতেই, হোটেলের সুটেড ইউনিফর্মপড়া একজনকে পিছু হেঁটে বেরুতে দেখলাম। পিছু হেঁটে হেঁটে দু’হাতে সে টেনে আনছে,এ জাতের হোটেলে যেমন থাকে তেমন চকচকে পিতলের চারডাণ্ডাসমৃদ্ধ লালমখমল মোড়ানো লাগেজট্রলি, তারই একটিকে। ট্রলিটিকে টেনে পিছু হেঁটে দরজাটি পার করিয়ে, সে ঘুরে দাঁড়াতেই মনে হল, একটু আগে সম্ভবত এই চায়নাম্যানই আমাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আমার ইশারায় পরিবারের বাকীদের লটবহর দেখেই উনি বুঝেছিলেন অতগুলো ব্যাগ সুটকেস টানা একা তার দুই হাতের কর্ম নয়, বরং ট্রলি লাগবে। সেজন্যই ওটা আনতে গিয়েছিল সে ভেতরে। অথচ এদিকে আমি কি না ঘটনা বুঝেছিলাম উল্টা! অবস্থা আমার হয়েছে তেমন , যেমন হয় চুন খেয়ে মুখ পোড়ানো মানুষের দই দেখে।
“কি ব্যাপার দাঁড়িয়ে আছি কেন আমরা এই ঠাণ্ডায়? চল ঢুকি হোটেলে” লাজুর কথার উত্তরে, চোখের ইশারায় ট্রলি আর বেলবয়ের দিকে নির্দেশ করতেই, ততক্ষণে ফের সেই বেলবয় সকলের চোখে একবার করে চোখ বুলিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ফের বাউ করে যন্ত্রচালিতের মতো ‘ওয়েলকাম তু লিজেন পেইজিং’ বলতে বলতে, বোঝাই করতে লেগে গেল তার ট্রলি।
যাক, বেলবয়কে যখন বুঝিয়ে দিতে পেরেছি লটবহর সব, এবার নিশ্চিন্তে ঢোকা যায় হোটেলে। সে মোতাবেক সবাইকে নিয়ে হোটেলে ঢোকার স্বয়ংক্রিয় সেই বৃত্তাকার গেইটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, আচ্ছা বেলবয় বলবো নাকি বেলম্যান বলবো লোকটাকে? আসলেই সে বয় নাকি ম্যান? তা তো বুঝতে পারছি না, তার চেহারা দেখে। তিন চারদিনের অভিজ্ঞতায় চায়নিজ চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ করার মতো সক্ষমতা অন্য কারো হলে হতেও পারে, কিন্তু আমার যে তা নেই, তা নিশ্চিত। অবশ্য এসব হোটেলের এই কাজটি যে বয়সের মানুষই করুক না কেন, ডাকা হয় তাদের বেলবয় হিসাবেই। এ পদে যে কাজ করে সেই মানুষের বয়স বাড়লেও, এই পদটির বয়স বাড়ে না মনে হয়।
এদিকে স্বয়ংক্রিয় দরজাটির সামনে দাঁড়াতেই সেটি সচল হয়ে গিয়ে কাচঘেরা অংশটি ঘুরে সরে গিয়ে, তার পেটের ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিতেই, চকিত চোখজরিপে বুঝলাম যে ওর ভেতরে আমাদের সকলকে একসাথে ধারন করার জন্য যথেষ্ট জায়গাই আছে। অতএব হুড়মুড় করে সবাইকে নিয়ে ঢুকে পড়লাম তার পেটে।
আর আমরা ঢুকে পড়তেই, মুখ বন্ধ করে ফেললেন গেইট মহাশয়। অতঃপর ধীরলয়ে ঘুরতে থাকা বৃত্তাকার দরজাটির সাথে তাল মিলিয়ে সবাই দু’য়েক পা ফেলে হোটেলের ভেতরে পা রাখতেই বদলে গেল আশপাশের আবহাওয়ার সাথে সামনের দৃশ্যপটও! এতোক্ষনের বাইরের আধোআলো আধোঅন্ধকারের হাড়হিম করা ঠাণ্ডা, আর জনমানবহীন সুনসান অবস্থার বদলে; প্রথমেই টের পেলাম সমস্ত শরীর জড়িয়ে ধরেছে উমউম গরমের আদুরে উষ্ণতা। বা দিকের আলো ঝলমলে লবি, যেটি গিয়ে থেমেছে রিসেপশন ডেস্কের সামনে, সেটির ডান পাশের আলোআঁধারিতে ঢাকা লাউঞ্জটি গম গম করছে মানুষে। ফের চকিত চোখজরিপে বুঝলাম জনসমাগমে জীবন্ত এই লাউঞ্জে উপস্থিত মানুষদের কেউ কেউ এ মুহূর্তে চুমুক দিচ্ছে চা/কফির কাপে, কেউবা খাচ্ছে স্ন্যাঙ, আবার কেউ কেউ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে অনুচ্চ স্বরে বলছে কথা। ঐ যে কোনাকুনি ডানদিকে লাউঞ্জটির শেষমাথার জায়গাটি, ঝলমলে আলোর বদলে যেখানটা মুড়িয়ে রেখেছে নরম আধো আলো, আধো অন্ধকার, ঐখানটার সাজসজ্জায় মনে হচ্ছে ওটা বার। অতএব ওখানে যারা বসে আছেন, তারা নিশ্চয় চুমুক দিচ্ছেন নানান রঙয়ের আর তেজের পানিয়ের গ্লাসে। মোট কথা আমাদের এতোক্ষনের বাইরের অবস্থার সাথে তুলনা করলে ভেতরের অবস্থাকে বলা যায় এক্কেবারে যাকে বলে ধুন্দুমার অবস্থা।
কুনমিংয়ের ইন্টারকন্টিনেন্টাল রিসোর্টের লবি আর লাউঞ্জের তুলনায়, বেইজিং রিজেন্ট হোটেলের এই লাউঞ্জটা নেহাতই ছোট। আর তা এমনই ছোট যে, এই লাউঞ্জটির আকারের, গোটা চার পাঁচটি লাউঞ্জ অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারে সেই ইন্টারকন্টিনেন্টালের লাউঞ্জের পেটের ভেতর। অবশ্য রিসোর্ট আর হোটেলের এই আকার আকৃতিগত পার্থক্যটা থাকাটাই স্বাভাবিক। এ পার্থক্য হল সেই পার্থক্য, যা নাকি দেখা যায় আজকাল আমাদের শহরগুলোতে নিজেদের বাপদাদাদের করা বাড়ির, সাথে হালের ফ্ল্যাটগুলোর। আধুনিক ফ্ল্যাটে আর্কিটেকচার ডিজাইনের চমক আর জাঁক থাকলেও, থাকে না যেমন তাতে ঠা ঠা খোলামেলা ভাব, এই লবিটির অবস্থাও অনেকটা তেমন। তবে যা বলেছিলাম আটোসাটো এই লাউঞ্জের ঠাট আর জাঁকের কমতি নেই কিছুই, বরং বলা চলে উপচেই পড়ছে তা। সবাইকে নিয়ে লবি ধরে, রিসেপশন কাউন্টারের দিকে এগুচ্ছি যখন, পাশ থেকে কানে এলো তখন হেলেনের গলা -‘আহ এই হোটেলটা তো মনে হচ্ছে কুনমিং এর টার চেয়ে অনেক ছোট’ হেলেনের এ কথার জবাবে, ‘দিস ইজ এ কূল হোটেল’ বলে একটু আগে দেয়া তার ঘোষণাটির পুনরাবৃত্তি করে অভ্র, ‘তাই না ভাইয়া’ বলে সমর্থন চাইল দীপ্রর। এরমধ্যে অবশ্য ওদের কথাবার্তা পিছু ফেলে গিয়ে দাঁড়িয়েছি নিজে রিসেপশনের চেক ইন কাউন্টারে, যেটি এ মুহূর্তে খালি সামনে, পেছনে দু দিকেই। কারণ এ সময়টায় আমরা বাদে আর কেউ নেই চেক ইন করার। আবার চেক আউটও করছেন না কেউ এ সময়টায়।
‘গুদ ইভিনিং, ওয়েলকাম তো লিজেন্ত পেইজিং। হাউ মে আই হেল্প ইউ’ বলতে বলতে হাসিমুখে এগিয়ে এলো সুটেড বুটেড এক চোস্ত চায়নিজ তরুণ, কাউন্টারে আমার উপস্থিতি লক্ষ্য করেই পেছনের কোন এক জায়গা থেকে।
ফিরতি হাসিতে ধন্যবাদ দিয়ে, ততোক্ষণে পাশে নামিয়ে রাখা পিঠব্যাগ থেকে হোটেল রিজার্ভেশনের কাগজটি বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে, বুকের ভেতরের নিঃশব্দ ধুকপুক ধুকপুক আশংকাটিকে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে অকারণ একটি আত্মবিশ্বাসী হাসি মুখে ঝুলিয়ে আশপাশ জরীপ করতে থাকলাম। হ্যাঁ খুব বেশিদিন না হলেও, বেশ কয়েক বছর ধরেই নিজেদের ভ্রমণের জন্য হোটেল রিজার্ভেশন নিজেই করি, অনলাইনে। তাতে এ পর্যন্ত দুয়েকবার রুমের কোয়ালিটি নিয়ে সমস্যায় পড়লেও, রুম একদমই পাই নি তা কিন্তু হয়নি কখনোই। তারপরও কেন জানি হোটেলে চেক ইন করার সময় প্রতিবারই আশংকায় ভুগি, এই বুঝি হোটেলের লোক বলে বসলো -‘না তো তোমার এই কাগজ মোতাবেক দেয়া কোন বুকিং তো দেখতে পাচ্ছি না আমাদের সিস্টেমে। অতএব দিতে পারছি না কোন রুম এখন, স্যরি !’
নিজের একাকি ভ্রমণে এরকম আশংকা যতোটা হয়, তার চেয়ে ঢের বেশী হয় তা যখন থাকে পরিবার সঙ্গে। তার উপর আছি তো এখন চায়নায়; যেখানে নাকি ইন্টারনেটের সুপারহাইওয়েতে এরা তুলে রেখেছে নানান দেয়াল,নয়তো কাঁটাতারের ব্যারিকেড।
অতএব ঢাকায় বসে ইন্টারনেটে দেয়া আমার সেই রিজার্ভেশনের খবর, ঐসব দেয়াল আর ব্যারিকেড পেরিয়ে এদের কম্পিউটার সিস্টেমের ঠিক জায়গায় জায়গা করে নিতে পেরেছিল কী না, কে জানে তা? তাই ঐ ধরনের গড়বড়ের প্রবল আশংকাই করছি এ মুহূর্তে বরং মনে মনে; কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়! কিন্তু আমার সেই আশংকাটির কোন ছায়া যাতে চেহারায় ভুলেও না পড়ে, সেটি নিশ্চিত করার জন্য ঠোঁটে আত্মবিশ্বাসের হাসি ঝুলিয়ে, মনে মনে ভাবছি এরকম বিনামেঘে বজ্রাঘাত জাতীয় বাক্যবানের জবাবে, মোক্ষম কি উত্তর দিয়ে কুপোকাত করতে পারি এদের। শত হলেও এ হলো নাম করা গ্লোবাল চেইনের হোটেল! এদেরই খালাতোভাই কানমিং এর ইন্টারকন্টিনেন্টাল, তাদের এক ভুলের মাশুল গুনেছে তিন তিনবার আক্কেল সেলামি দিয়ে। যে চমকের মুগ্ধতার রেশ এখনো ছড়িয়ে আছে অন্তত আমার মনে। ব্যত্যয় হবে না তার নিশ্চয় এখানেও।
‘পাসপোর্ত প্লিজ’ সামনের কম্পিউটারে কিছুক্ষণ খুটখাট করেই চায়নিজ যুবক হাসিমুখে চোখে চোখ রেখে বলতেই , হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম এই জন্য যে, এই হিমরাতে অকারণ কোন ঝামেলায় পড়তে হল না। তড়িঘড়ি পাশ ব্যাগ থেকে নিজের পাসপোর্ট বের করে দিয়ে, লাজু আর হেলেনের কাছ থেকে বাকি পাসপোর্টগুলো নিয়ে সবগুলো কাউন্টারের ওপাশে ঐ যুবককে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে ততক্ষণে এসে দাঁড়ানো এক চায়নাকন্যার হাতে চালান করে দিয়ে, তুমুল তৃষ্ণার্ত চোখ আমার ফের নিজের অজান্তেই চলে গেল লাউঞ্জটির সম্ভাব্য বারটির দিকেই।
“হিয়ার ইজ ইউর কি স্যার, এনজয় ইউর স্টে” বলেই যুবক কেতামাফিক আরো বলে দিল কোন দিকে গিয়ে কোন লিফটের ১৫ নম্বর বোতামে চাপ দিতে হবে আমাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষের ঠিকানায় যেতে। সাথে এও বললো যে, অচিরেই সে আমাদের লটবহরও রুমে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। সামান্য চিংলিশ টান থাকলেও তার স্পষ্ট ইংরেজি বুঝতে অসুবিধা হলো না মোটেই, এতে বেশ হাঁফই ছাড়লাম ।
চাবিকার্ডের নম্বরে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম নাহ এবারেও পাশাপাশি দুটো রুম পাইনি সম্ভবত। এতে সামান্য এক চিলতে বিরক্তির মেঘ মনে নিয়ে, সবাইকে লিফটমুখি হাঁটার তাড়া দিয়ে কিছুটা এগুতেই দেখা হলো ট্রলিভর্তি আমাদের লটবহরসমেত একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বেলম্যান, নাহ বেলবয়ের।
হাসিমুখের জয় সর্বত্রই হয়, কথাটিকে প্রমাণিত করে একটু আগে একটু বিরক্তির মেঘের আভাস এসেছিল মনে, চলে গেল তা কোন সুদূরে বেলবয়ের হাসির ঝাপটায়। তার বদলে বরং ভাবলাম, তাও ভাল যে একই তলায় পেয়েছি রুম । বুকিং করার সময় তো রেগুলার প্রাইসের রুমের বদলে স্পেশাল ডিসকাউন্টের রুমই নিয়েছিলাম। সেরকম অবস্থায় একই তলায় রুম পাওয়া তো বরং সৌভাগ্যই! পাল্টা হাসিতে তাই বেলবয়ের চোখের সামনে মেলে ধরলাম একটু আগে হস্তগত হওয়া আমাদের ঠিকানাকার্ড দুটো। একনজর তা দেখেই সে ফের হাসিমাখা মুখে মাথা ঝুঁকিয়ে নিঃশব্দে যা বললো তার অনুবাদ হয় ‘নো চিন্তা ডু ফুর্তি, নিয়ে আসছি অচিরেই তোমাদের লটবহর আমি’।
লিফটের দিকে এগুতে এগুতে অভ্রকে বললাম, বাবা এখানে তো লিফট ছাড়া উপায় নাই। আমাদের রুম তো হল ১৫ তলায়। অবশ্য এরই মধ্যে এই হোটেলকে কূল হোটেলের সার্টিফিকেট দিয়ে ফেলা অভ্র যে আমার এ কথায় মোটেও গা করবে না, জানাই ছিল তা। তাও বললাম, আর উত্তরে পেলাম পুরস্কার পুত্রের একগাল অনির্বচনীয় অমল হাসি!
লিফটের দরজা খুলতেই, সবাই ওর পেটে ঢুকে যাওয়ার পর, অভ্র দীপ্র দুজনেরই আঙ্গুল একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লো ১৫ নম্বর বোতামের উপর। অচিরেই এই দ্বৈত আদেশের ফলে কী না জানি না, দ্রুতই দরজা বন্ধ করে লিফট মহাশয় শুরু করেছে তার উর্ধাগমন যখন, তখনই কিছুটা বিরক্ত দীপ্র বললো -‘ওকে ওকে ইটস থ্রি থ্রি’!
বুঝলাম চলছে তাদের কোন একটা খেলা ফের। এতোক্ষণ যেহেতু তাদের কর্মকাণ্ডের দিকে খেয়াল করতে পারিনি, তাই ধরতে পারিনি ব্যাপারটা প্রথমে। অতএব ব্যাপারটি খোলাসা করার জন্য মুখ খুলতেই দীপ্র বলল -আজ সন্ধ্যায় সে প্রথমে হোটেলটির নাম দেখে, এক শূন্য ব্যবধানে এগিয়ে গেলেও, অভ্র অচিরেই ড্র করে ফেলেছিল ঐ লাল ফেরারিটি আগে দেখে! তারপর দীপ্র আবার যেই এগিয়ে গিয়েছিল ‘এস্টন মার্টিন’ গাড়িটি দেখে, অভ্র সাথে সাথে সমতা এনে ফেলেছিল “মাজারাতি”র ঘোষণা দিয়ে। অতএব ফলাফল ছিল ২-২, আর এখন যখন তার দুজনেই একসাথে লিফটের বোতাম চেপেছে, তাই ওটা দাঁড়িয়েছে ৩-৩ এ। নিজেদের বানানো খেলা বিষয়ক দীপ্র সেই জটিল ব্যাখ্যা শেষ হতেই এসময় লিফট থেমে গিয়ে দরজা খুলতেই, তার প্যানেলের দিকে তাকিয়ে ১৫ নম্বর বাতিটি স্থির জ্বলে থাকতে দেখে বুঝলাম সকলেই একসাথে যে, পৌঁছে গেছি আমাদের মঞ্জিলে মঙুদে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক