তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা পাওয়া দেশটি আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়নে রোল মডেল। ১৩ বছরে শাসনকালে সরকারের অর্জনের ‘ঝুড়ি’ আজ উন্নয়নে ভরপুর। সরকারের দক্ষ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ফলে রাজস্ব আহরণে উর্ধ্বগতি এবং ঋণ গ্রহণে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি মূল্যস্থীতিও উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের ঈর্ষণীয় সাফল্য লক্ষ্যণীয়। ব্যাংক খাতে নানা অনিয়ম ও ঋণ বিতরণে কেলেংকারির মধ্যেও আমানতের হার ও ঋণ বিতরণ বেড়েছে, গতিশীল হয়েছে বেসরকারি খাত। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের ঈর্ষণীয় সাফল্য বিশ্বের অনেক দেশের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বর্তমানে পদ্মা সেতু একটি আবেগের নাম। বহুমুখী পদ্মাসেতু আজ আর স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। এ সেতু বাংলাদেশের গৌরব এবং সফলতার প্রতীক। ৩০ জুন ২০২২ পদ্মাসেতু উন্মুক্ত করা হলে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পদ্মাসেতুর মাধ্যমে মংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থল বন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে বদলে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আশা করা যাচ্ছে অক্টোবর ২০২২ সালে এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। ১০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য দুইটি টিউব দ্বারা তৈরি এ টানেল যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হলে কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড় হতে কক্সবাজার পর্যন্ত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রাখবে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পারমানিবক বিশ্বে পদার্পণ করবে এবং ইতিমধ্যে বাংলাদেশ বিশ্ব পরমাণু ক্লাবের সদস্য পদ লাভ করেছে। বিগত সময়ে সরকারের সফলতা এতই পরমানবিক বিস্তৃত যে তা বিশ্বের নিকট একটি চমক হিসেবে দেখা দিয়েছে। দুর্বার গতিতে দেশের অগ্রযাত্রার সফলতার সাথে সাথে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের কাতারে শামিল হওয়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের জ্বালানিখাত পুরোপুরি আমদানি নির্ভর হওয়ার কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদনের হার ক্রমাগতভাবে কমে যাওয়া এবং দেশে গ্যাসের চাহিদা বাড়ার কারণে যে গ্যাস সংকট দেখা দেয় তা মেটানোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্রুত দিক নির্দেশনায় ‘এলএনজি’ রূপে গ্যাস আমদানি শুরু করা হয়। বাংলাদেশ আগে থেকেই পুরোপুরিভাবে তেল আমদানির উপর নির্ভরশীল ছিল। সম্প্রতি বৃহদাকারে কয়লা আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে গ্যাস আমদানি বৃদ্ধি পেলে সমগ্র জ্বালানি খাত আমদানির নির্ভর হয়ে পড়ার শঙ্কা দেশের নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলেছে।
দেশের গ্যাস সংকট মোকাবেলায় গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৮ সালের শেষের দিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। এলএনজি একটি উচ্চমূল্যের জ্বালানি পণ্য এবং এটি ব্যবহারের জন্য অতি উচ্চ ব্যয়বহুল অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব বাজারে এলএনজির আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি এবং এর মূল্যের অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা জ্বালানি বিশেষজ্ঞদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ২০টি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এর মধ্যে শেভরন অয়েল কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত অপেক্ষাকৃত নতুন বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রটিকে মুকুটের মণি হিসেবে গণ্য করা হয়। এ গ্যাসক্ষেত্র হতে দৈনিক ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়। এর ধারাবাহিকতা কতদিন থাকবে? সেটিও এখন প্রশ্ন। যদি এর উৎপাদন হ্রাস পায় তবে বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
বর্তমানে গ্যাস সংকট মেটানোর জন্য ১৮ শতাংশ আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। দেশীয় উৎপাদনের হার নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থাকলে এলএনজি নির্ভরতা বেড়ে যেতে পারে। উচ্চমূল্যের এলএনজির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরতা দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং তা মোটেই টেকসই হবে না। বাংলাদেশের সাথে দীর্ঘমেয়াদে চুক্তিতে অপেক্ষাকৃত কম ও স্থায়ী মূল্যে ইউনিট প্রতি ১০ ডলারে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল কাতার ও ওমান। তবে দীর্ঘমেয়াদী অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে এলএনজি সরবরাহ নেয়ার চেয়ে বেশি মূল্যে স্পট মার্কেট হতে এলএনজি সরবরাহ নেয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহল অতি উৎসাহি বলে মনে হয়।
বর্তমান প্রাক্কলন অনুযায়ী দেশের নিজস্ব গ্যাস উৎস থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এলএনজি আমদানির পরিমাণও বাড়বে। ভবিষ্যতে এলএনজি দেশীয় গ্যাসের সরবরাহের তুলনায় অধিক হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের অর্থনীতি জ্বালানি খাতের এমন আর্থিক বোঝা কত দিন সামাল দিতে পারবে? তবে এটা নিশ্চিত যে আর্থিক চাপের কারণে যদি সাময়িকভাবেও এলএনজি গ্যাসের আমদানি বন্ধ করতে হয় তাহলে দেশের অনেক অনেক গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ ও শিল্পের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে এবং তাদেরকে অন্ধকারে ফেলে দিবে। এতে বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শিল্পে বিনিয়োগ হুমকির মধ্যে পড়বে। দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ হলে হাজার হাজার জনবল বেকার হয়ে পড়বে এবং অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এতে দেশে এবং বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের অর্জিত সফলতা ম্লান হবে। বর্ণিত জ্বালানি সমস্যা হতে বের হয়ে আসতে হলে পথ একটাই। বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ধরে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানে কোনো জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে দেশে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য কেবল বেড়েই চলেছে। অথচ ভূতাত্ত্বিক বিবেচনায় বদ্বীপ নিয়ে গঠিত এ দেশটির গ্যাস সম্ভাবনাকে অতি উজ্জ্বল বলে বিজ্ঞানিরা মত দিয়ে এসেছেন।
২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্র সীমানার বিরোধ নিস্পত্তির পর মিয়ানমার তার সমুদ্র এলাকায় জোরালো অনুসন্ধানের মাধ্যমে বড় আকারের গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমায় সে তুলনায় অনুসন্ধান কাজ করেনি বললেই চলে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমা অনুসন্ধান কাজের ব্যাপক সফলতা পেয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ৬ জানুয়ারী ২০২২ এর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে পাওয়া তথ্য মতে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় ২২০ প্রজাতির সি-উইড (সামুদ্রিক শৈবাল), ৫৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবষ্টার, ৬ প্রজাতির কাকড়া, ৬১ প্রজাতির সিলগ্রাস পাওয়া গেছে। সবচেয়ে আনন্দের ও আশাব্যঞ্জক খবর হলো সমুদ্র পিষ্ঠে ১০৩ টিসিএফ গ্যাস হাইড্রেটের তথা মিথেন গ্যাসের সন্ধান পাওয়া। দেশের গ্যাসের সমাধানের জন্য দ্রুত এ গ্যাস ব্যবহারের পরিকল্পনা প্রয়োজন।
সুতরাং গ্যাস সরবরাহের সমস্যাকে একটি টেকসই সমাধান দিতে হলে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা খুবই জরুরি। দেশের উন্নয়নের অগ্রগতির ক্ষেত্রে আরেকটি ও অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধুর শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা এবং ভিশন-৪১ বাস্তবায়ন করার জন্য দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা যা সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। নানাভাবে নতুন নতুন কায়দায় দুর্নীতি হচ্ছে। নিয়োগ দুর্নীতি, কেনাকেটায় দুর্নীতি, পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে দুর্নীতি, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি, নির্বাচনে নেতৃত্ব মনোনয়নে দুর্নীতি, অর্থ ও উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে দুর্নীতি হচ্ছেনা। বর্তমানে দুর্নীতি যেন এক মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই জরুরি।
সব কিছুর মাঝেও বলতে হয় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে, উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের তিন বছরপূর্তিতে জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে যে বক্তব্য প্রদান করেন তা প্রণিধানযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়ক বেয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা অনেকের সহ্য হবেনা বা হচ্ছেনা। দেশ-বিদেশে বসে বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিরা নানা ষড়যন্ত্র করছে এই অগ্রযাত্রাকে রুখে দেয়ার জন্য। মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক তথ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বিদেশে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউ যাতে মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে দিকে আমাদের সকলকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে কোনোভাবেই ব্যাহত হতে দেয়া যাবেনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের চলমান উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে দেশবাসী অতীতের মতো ভবিষ্যতেও বর্তমান সরকারের সঙ্গে থাকবেন এমন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন’। তিনি আরো বলেন, ‘জনগণের সরকার হিসেবে মানুষের জীবন মান উন্নয়ন করা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলেই আমি মনে করি। গত ১৩ বছরে আমরা আপনাদের জন্য কী কী করেছি, তা আপনারাই মূল্যায়ন করবেন। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, আমরা যে সব ওয়াদা দিয়েছিলাম আমরা তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি’।
দেশের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চিহ্নিত ও নতুনভাবে সৃষ্ঠ সমস্যা সমূহের সমাধান করে এবং ইতিবাচক দিকগুলোকে সুসংহত ও ত্বরান্বিত করে আমরা দৃপ্তপদে এগিয়ে যাব। ২০৩০ নাগাদ টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গববন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে উঠবে এটি আমাদের লক্ষ্য এবং স্বপ্ন, তা বাস্তবায়নের পথ বেশি দূরে নয়। শেখ হাসিনার সফল ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন হোক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও অংশ গ্রহণে সফলতা আসবেই এবং আসতে বাধ্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক-শিল্পশৈলী