(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দিল্লীর রাস্তায় জ্যামে আটকে আছি বহুক্ষণ ধরে। সন্ধ্যার পরে এমন ট্রাফিক দিল্লী শহরের প্রাত্যহিক চিত্র। ভারতে মোটর সাইকেল বেশ সস্তা, গাড়িও। দেশীয় কোম্পানির কারখানার পাশাপাশি বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন কোম্পানি জয়েন্টভেঞ্চারে ভারতে গাড়ি তৈরি করে। চড়া শুল্ক না থাকায় বেশ সস্তায় এসব বাহন মিলে ভারতের বাজারে। টাটা কোম্পানি মাত্র এক লাখ রূপিতে অতি সাধারণ মানুষের ঘরেও পৌঁছে দিয়েছে চার চাকার গাড়ি। তিন থেকে পাঁচ লাখ রূপিতে মোটামুটি ভালো মানের গাড়ি হাঁকানো যায় ভারতে। বিশ পঁচিশ লাখ টাকা খরচ করলেতো আমাদের কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে দাবড়ানো যায় ভারতের অলি গলি রাজপথ। এমন সুযোগ কে-ই বা হাতছাড়া করেন! তাই প্রচুর গাড়ি কিনেন অবস্থাপন্ন মানুষ। প্রচুর গাড়ি নামে রাস্তায়। নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেনীর ঘরে ঘরে মোটরসাইকেল যেন অতি সাধারণ বাহন।
ভারতের মোটামুটি অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোর প্রত্যেকটিতেই নিজেদের গাড়ি বা মোটরসাইকেল রয়েছে। কোন কোন পরিবারে একাধিক। ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ি সবাই গাড়ি চালান। মেয়েরা যেভাবে মোটর সাইকেল এবং স্কুটি নিয়ে দাবড়ে বেড়ান তাও একটি দেখার বিষয়। কেউ গাড়ি চালাচ্ছেন আবার কেউবা মোটরসাইকেল। গাড়িতে গাড়িতে স্থবির হয়ে ওঠা রাস্তায় বাড়তি প্রেসার তৈরি করে হাজার হাজার মোটরসাইকেল। দিল্লীতে দিনভরই যানজট থাকে বিভিন্ন এলাকায়। তবে সন্ধ্যার পর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বহু এলাকার রাস্তার স্বাভাবিক গাড়ি চলাচল মুখ থুবড়ে পড়ে। ঘরে ফেরা মানুষের চাপে হিমশিম খায় পুলিশ, ট্রাফিক সিগন্যাল। আমরা ঘরে ফেরা মানুষের বিশাল কাফেলায় আটকে আছি। আমাদের গাড়ির সামনে পেছনে লেটেস্ট মডেলের অসংখ্য গাড়ি। ভয়াবহ রকমের এই জ্যাম থেকে ঠিক কতক্ষণে মুক্তি পাবো বুঝতে পারছিলাম না। নিজেদের ট্যুর অপারেটরের দেয়া গাড়ি না হলে এমন জ্যামে টেনশনের অন্ত থাকে না।
বেশ ধীরলয়ে এগুচ্ছিল আমাদের গাড়ি। সামনে আর কতটুকু পথ গেলে জ্যামের অবসান হবে কিংবা আমাদের হোটেল কতদূরে তার সবই অজানা। অন্যরকমের এক অস্থিরতার মাঝে আমার বেড়ানোর আনন্দই মাটি হওয়ার উপক্রম হলো। কেন যে এতক্ষণ দেরি করে ফিরতি পথ ধরলাম তা ভেবে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল। অফিস ফেরত মানুষ পথে নামার আগে হোটেলে ফিরে গেলে এমনতর বেকায়দায় পড়তে হতো না। আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক ইতোমধ্যে দুই বার ফোন করেছেন। আমরা কতদূর, ফিরতে কতক্ষণ লাগবে, কোন সমস্যা হয়েছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করলেন। ডিনারের জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন বলেও জানালেন। আমি রাস্তার জ্যামের কথা বললাম। আমাদের জন্য অপেক্ষা না করে সবাইকে নিয়ে ডিনার করে ফেলার জন্য স্যারকে অনুরোধ করলাম। বললাম, আমরা ফিরে কিছু একটা খেয়ে নেবো। কিন্তু স্যার আমার প্রস্তাবে সায় না দিয়ে অপেক্ষা করবেন বলে জানালেন। বললেন, ‘আস, একটু দেরি হলে কোন সমস্যা নেই।’
দিল্লীতে আমাদের সাতদিনের ট্যুর শেষ হচ্ছে। সকালে কলকাতার পথ ধরবো আমরা, বিমানে। সকালে এয়ারপোর্টে আমাদের নামিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে চালকের ডিউটি। আমি একটু বাড়তি চালাকির আশ্রয় নিলাম। গাড়ি থেকে নামার পর চালক বেশ শব্দ করে সালাম দিলেও কোন ট্রিপস দিলাম না। প্রতিদিন উনাকে ট্রিপস দিলেও আজ বললাম, ‘সকালে আসুন, দেখা হবে।’
এই ভারতেরই একটি ঘটনা জীবনে ভুলবো না। তাই ড্রাইভারের ব্যাপারে আমার এই নিষ্ঠুরতা। বম্বের একটি ঘটনা মনে পড়লো আমার। মনে পড়লো কেন, প্রায়শ মনে পড়ে। ঘটনাটি আমি ভুলতে পারিনা বললেই চলে। একজন ড্রাইভার যে বিদেশে কি পরিমান বেকায়দায় ফেলতে পারেন তা ভেবে এখনো আমার কলজে মুচড়ে উঠে। বিদেশ যাওয়ার আগেই ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে আমি বম্বে শহরের জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলাম। বিমানবন্দর থেকে আমাকে রিসিভ করে নানা স্থানে ঘুরিয়ে দেখাবেন তিনি। ট্যুর শেষে আবারো আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবেন। এটি ছিল চুক্তি। শেষদিন পুনেসহ নানা স্থানে ঘুরেটুরে ফুরফুরে মেজাজে ফিরেছিলাম হোটেলে। লবিতে নেমে ড্রাইভারকে বেশ ভালোমতো ট্রিপস দিয়েছিলাম। পরদিন ভোর পাঁচটা নাগাদ আমাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়ার কথা পাকা করে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলাম তাকে।
ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। হোটেলের চেকআউট সম্পন্ন করে ড্রাইভারের অপেক্ষা করছিলাম। লবিতে বসে প্রহর গুনছিলাম আমি। কিন্তু ড্রাইভারের কোন হদিশ পাচ্ছিলাম না। তার ফোনও বন্ধ। পাঁচটা তো দূরের কথা সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত উনার কোন খবরই পেলাম না। উনি ফোন খুললেন না, ফোন করলেন না। প্রতিটি সেকেন্ড অসহনীয় এক প্রতীক্ষায় চরম অস্থিরতায় সময় পার করছিলাম আমি। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। হোটেলের সামনে রাস্তায় থৈ থৈ করছে পানি। সকাল সাতটায় আমার ফ্লাইট। কিন্তু কি করে ফ্লাইট ধরবো! বম্বে থেকে দিল্লী হয়ে কলকাতা। একটি ফ্লাইট মিস হলে পরবর্তী সবগুলো সিডিউলই আমার নষ্ট হয়ে যাবে। বম্বে থেকে দিল্লী কিংবা দিল্লী থেকে কলকাতার ফ্লাইটের টিকেট, হোটেলের পেমেন্ট সবই হয়ে গেছে। অথচ আমাকে বিমানবন্দরে নেয়ার জন্য ড্রাইভারেরই খবর নেই। ঘড়ির কাঁটা তরতর করে সামনে এগুচ্ছে!
আমার অস্থিরতা দেখে হোটেলটির রিসিপশনের এক তরুণ এগিয়ে আসলেন। বললেন, আমার গাড়ি লাগবে কিনা। আমি যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে বেশ চড়া ভাড়ায় একটি গাড়ি নিয়ে আমি এয়ারপোর্ট পৌঁছেছিলাম। তিনদিন ধরে বম্বে শহরে আমাকে নিয়ে ঘুরে, একসাথে নানাভাবে খাওয়া দাওয়া করে বেশ ‘বন্ধু’ হয়ে উঠা ড্রাইভার শেষদিন কেন এমন করে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন সেই রহস্যের কোন কিনারা আজো আমি করতে পারিনি। তবে ওই ঘটনাটি চমৎকার একটি শিক্ষা দিয়েছে আমাকে। যেই শিক্ষার করুণ শিকার আজকের ড্রাইভার। আমি ড্রাইভারের ট্রিপসের পাঠ না চুকিয়ে ঝুলিয়ে রাখলাম। পরদিন আসলে ট্রিপস পাবেন, নাহয় পাবেন না। ট্রিপসের লোভে হলেও যদি তিনি সময়মতো হাজির হন। অবশ্য, আমাদের গাড়ির ড্রাইভার না হলেও কোন সমস্যা হবে না। আমাদের গ্রুপের অপর চারটি গাড়ির যে কোন একটিতে আমাদের দুজনের জায়গা হয়ে যাবে।
রুমে ঢুকেই ঘড়ি দেখলাম। না, ডিনারের জন্য খুব একটা দেরি হয়নি। দেশে এত তাড়াতাড়ি আমরা টেবিলের ধারে কাছেও যাইনা। এডিটর স্যারকে ফোন করলাম। তিনি সকলকে ফোন করে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য বলতে বললেন। যথারীতি সবগুলো রুমে ফোন করলাম। সবাইকে পেয়েও গেলাম। আমি স্ত্রীকে নিয়ে দ্রুত রেস্টুরেন্টে গেলাম। অবশ্য রুম থেকে বের হওয়ার আগে যথারীতি ফোন করে সিট বুকিং দিলাম। গতকালের সুললিত কণ্ঠের তরুণী মনে হয় আজো ডিউটিতে। তিনি চমৎকার সিট রাখবেন বলে আশ্বস্ত করলেন আমাকে।
আমাদের এগারজনের বসার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। তিনটি টেবিল জোড়া দিয়ে বেশ সুন্দর আয়োজন। গতরাতের মতো। আজও জানালার পাশেই আমাদের সিট। কাচের ভিতর দিয়ে নিচের রাজপথ বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছিল। আলোর বন্যা বাইরে। স্ট্রিট লাইটের পাশাপাশি গাড়ি এবং ভবনে ভবনে আলো। আলোয় আলোয় ভরা দিল্লীর এই দৃশ্যে বেশ নান্দনিকতা রয়েছে। গাড়ি চলাচলও বেশ বেড়েছে বলে মনে হলো। রাত বাড়ার সাথে সাথে বুঝি গতিও বাড়ে!
আমি স্ত্রীকে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলাম। একে একে আমাদের গ্রুপের সকলেই এসে হাজির হলেন। আমার এডিটর স্যার লায়ন এম এ মালেক, লায়ন মিসেস কামরুন মালেক, কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম কর্ণধার লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া, লায়ন সুপ্রভা বড়ুয়া, মুনতাহা গ্রুপের কর্ণধার লায়ন মনজুর আলম মনজু, লায়ন রাশু মনজু, ওনাদের ছোট মেয়ে মানারা, লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী (রেহেনা) টেবিলে এসে বসলেন। খাওয়া দাওয়া হলো। বেশ সময় নিয়ে আড্ডাও চললো যথারীতি। রেস্টুরেন্টে আরো বহু মানুষ, নারী পুরুষ। খাওয়া দাওয়ার পর সকলেই ব্যস্ত গল্পগুজবে। তারকাখচিত রেস্টুরেন্টগুলোতে যতটুকু না খাওয়া দাওয়া চলে তার থেকে ঢের বেশ চলে আনন্দ উৎসব। আমি চারদিকে সেই আনন্দেরই মহোৎসব দেখছিলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।