দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১ জুন, ২০২২ at ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

শুরু থেকে বিষয়টি বেশ গোলমেলে লাগছিল। এই গহীন পাহাড়ে এত গুহা কোত্থেকে আসলো? এত গুহা তৈরি বা করলো কারা? কিভাবে তৈরি হলো! প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হলে সব গুহা শুধু এখানে হলো কেন? আবার একটি বিশেষ সময়ে তৈরি হলো, এখন আর হচ্ছে না কেন? এই ধরনের হাজারো প্রশ্ন নাকি গুহাগুলোকে নিয়ে ঘুরপাক খায়। আবিস্কারের পর থেকে গত কয়েক বছর এসব গুহা নিয়ে আলোচনায় সরগরম চারপাশ। এত গুহা এখানে কোত্থেকে আসলো এটিই নাকি সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কারো কারো মতে ভিনগ্রহ থেকে এলিয়ন টাইপের কিছু এসে নাকি গুহাগুলো করে গেছে!

কোথাও গেলে আমি জাদুঘর দেখার জন্য বেশ আগ্রহি হয়ে উঠি, তবে এখানে গুহা দর্শনে তেমন কোন আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। সাথীদের সবাই এসেছেন বলে আমারও আসা। খাগড়াছড়ির আলুটিলায় একবার গুহা দেখতে গিয়ে মরতে বসেছিলাম। পাথরে পা পিছলে পড়ে বেশ প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম ভয়ও। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে কোথায় যে পা ফেলছিলাম ঠাহর করতে পারছিলাম না। তীব্র পিচ্ছিল পাথুরে পথ যেন ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে থাকা সংকীর্ণ এবং সরু পথটি পাড়ি দেয়া কী যে কঠিন হয়ে হয়েছিল! পরবর্তীতে বহু দফায় আমি আলুটিলা গেলেও ভুলেও ওই গুহামুখে আর যাইনি। প্রথম দর্শনে গুহার প্রতি আগ্রহ হারানো এই আমি জীবনে আর কোন গুহার দিকে পা বাড়াইনি। এখন বহু বছর পর চীনের দুর্গম পাহাড়ের এই গুহা অভিযানে আমার ভাগ্যে ঠিক কি আছে কে জানে!

গুহার দিকে যতই এগুচ্ছিলাম ততই চাঞ্চল্য বোধ করছিলাম। শত শত নারী পুরুষ গিজগিজ করছে। রঙবেরঙের পোশাকে সুসজ্জিত নানা বয়সী মানুষ। অধিকাংশই তরুণ তরুণী। গুহা দেখতে ভীড় লেগে গেছে! এসেছেন রহস্যমোড়া সুড়ঙ্গের কিছু রহস্য ছুঁয়ে দেখতে।

ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কিন্তু চ্যাপ্টা নাকের সুন্দরী এক তরুণী। আমাদের সাথে রয়েছেন জ্যাক কোম্পানির কর্মকর্তা জেসি। জেসিও তরুণী, বেশ স্মার্ট এবং সুন্দরী। জেসি আমাদের লোকাল গাডিয়ান। গুহা বিশেষজ্ঞ একজন গাইডও আমাদের জন্য নেয়া হয়েছে। সবকিছু মিলে আমাদের ট্যুর যাতে সুন্দর হয় তার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা জ্যাক কোম্পানির পক্ষ থেকে করা হয়েছে।

লায়ন ফজলে করিম আমাদেরকে তাড়া দিলেন। বললেন, ‘দ্রুত না ঢুকলে সমস্যা হবে। সবকিছু দেখে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না। গুহা দেখতে অনেক সময় লেগে যাবে।’ করিম ভাই আগে কোনদিন এখানে আসেননি, কোন পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই। তিনিও আমাদের মতোই প্রথম গুহা দর্শনে এসেছেন। তবে জ্যাকের কর্মকর্তা জেসির তাগাদা খেয়ে করিম ভাই আমাদের তাড়া দিলেন। করিম ভাই প্রথম আসলেও চীনা ভাষায় দক্ষতার কারণে তিনি সবকিছুতে এগিয়ে রয়েছেন। ব্যানারে পোস্টারে অনেক কিছু লেখা রয়েছে। করিমভাই সে সব অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারেন। আমরা অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকলেও করিম ভাই সবকিছুতেই এগিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র একটি ভাষাজ্ঞান যে মানুষকে কী করে কতটুকু এগিয়ে রাখে তা আমি চিন্তা করছিলাম। চীনসহ সন্নিহিত অঞ্চলের দেশগুলোতে ইংরেজীর অবস্থা বেহাল। একটি ইংরেজী শব্দও তারা বলেন না। চীন কিংবা জাপানের বহু মানুষ ভালো ইংরেজী জানেন। কিন্তু কী এক আক্রোশে একটি শব্দও বলেননা। তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন। আপনার ইচ্ছে হলে শুনুন, ইচ্ছে না হলে শুনবেন না। আপনার মন চাইলে এই ভাষা শিখে ব্যবসা বাণিজ্য করুন, আর মন না চাইলে কেটে পড়ুন। নিজের মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কারো ভাষা তারা পারতপক্ষে মুখেও আনে না। কোথায় যেন লিখেছিলাম, ‘চীন জাপান তাইওয়ান থাইল্যান্ড হংকংসহ সন্নিহিত অঞ্চলের মানুষগুলো মায়ের ভাষার জন্য রক্ত দেয়নি, কিন্তু মায়ের ভাষাকে সম্মানের এক অনন্য উচ্চতায় তারা নিয়ে গেছে। আমরা মায়ের ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি ঠিকই কিন্তু মায়ের ভাষাকে তাদের মতো সম্মানজনক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারিনি।” তাদের কথা হচ্ছে আমার ভাষায় আমি কথা বলবো, তুমি ব্যবসা করতে চাইলে আমার ভাষা শিখে আসো। এতে করে পশ্চিমা দেশগুলোর বহু ইংরেজীভাষী মানুষ মান্ডারিন ভাষা শিখে চীনে ব্যবসা বাণিজ্য করছেন।

আমাদের লায়ন ফজলে করিম ভাইও চীনের সাথে ব্যবসা করেন। তাই তিনিও চীনা ভাষা রপ্ত করে নিয়েছেন। আর চীনা ভাষা জানার কারণে উনি সবকিছুতে আমাদের থেকে এগিয়ে রয়েছেন।

গুহা দেখার জন্য আমাদের প্রত্যেকের টিকেট করতে হয়েছে। জ্যাক কোম্পানির পক্ষ থেকেই আমাদের টিকেট করলেন জেসি। টিকেটের দামও বেশ চড়া, প্রতিটি ২০০ আরএমবি (বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার ৭শ’ টাকা)। একটি গুহা দেখার টিকেটের দাম এত বেশি কেন? এত টাকার টিকেট কেটে গুহাও বা দেখতে হবে কেন বুঝতে পারছিলাম না। নাকি ভালো কিছু আছে কে জানে!

সামনে এগুলাম আমরা। গুহার মুখে বিরাট একটি পাথর। একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে। পাথরটি মুখে এনে দিলে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। তবে পাথরটি এত বড় যে সেটি নড়াতে কয়েকশ’ মানুষ লাগবে। হাতি দিয়ে এই পাথর ঠেলা হতো কিনা কে জানে! গুহার মুখটি অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ, সরু। সেই সরু পথটি দিয়ে আমরা গুহার ভিতরে প্রবেশ করলাম। আর একটু খানি এগুতেই মনে হলো যেন নিজে নিজে চমকে উঠলাম! সরু একটি পথ পার হওয়ার পরই এত বিস্তৃত একটি গুহা। যেন খোলামেলা একটি চত্বর, চমৎকার একটি ড্রয়িং রুম। গাইড বললেন, গুহাগুলো বেলে পাথরের তৈরি। বছরের পর বছর ধরে এগুলো একইভাবে একইরকম রয়েছে। কোন পরিবর্তন নেই, পরিবর্ধন নেই। ধসে পড়া কিংবা ক্ষয়ে যাওয়া নেই। এসব গুহা প্রাচীন যুগের অতি আশ্চর্য একটি স্থাপনা। দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো এসব গুহার আর্কিটেকচারাল গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং নির্মাণশৈলী দেখে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, আধুনিককালের স্থপতি, পুরাতত্ত্ববিদ এবং প্রকৌশলীরা ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে থাকেন। কি করে সম্ভব? কি করে এমন নির্মাণশৈলী অনুসরণ করে এমন দুর্দান্ত স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছিল! এগুলো যে প্রাকৃতি নয় সেই সম্পর্কে মানুষ নিশ্চিত। এগুলোতে নানা রকমের শিল্পকর্ম রয়েছে। রয়েছে হাতি ঘোড়াসহ নানা রকমের পশু পাখীর ছবি, চিত্রকর্ম। এগুলো মানুষেরই কাজ। তবে ঠিক কত মানুষের কতদিনের নিরলস পরিশ্রমে এমন এক একটি গুহা তৈরি হয়েছে তা কেউ বলতে পারছেন না। দিনের পর দিন গবেষণা করেও গুহাগুলো সম্পর্কে বিশেষ কিছু নিশ্চিত হতে না পারার ব্যাপারটিও বিস্ময়কর।

গুহাগুলোর ভিতরে অসাধারণ সব আয়োজন। তবে কোথাও রান্নাবান্না বা ঘুমানোর মতো কোন আয়োজন দেখা গেল না। তাহলে এসব গুহা কেন বানানো হয়েছিল? গুহার ভিতরে সিঁড়ি রয়েছে, সিঁড়ি দিয়ে পাহাড়ের উপরের দিকে যাওয়ারও পথ রয়েছে। বৃষ্টির পানি ঠেকানোর ব্যবস্থা রয়েছে। বিশাল বিশাল গুহা, পাহাড়ের খাদে। প্রবেশ করার পথ সংকীর্ণ। সূর্যের আলো সরাসরি ভিতরে প্রবেশের সুযোগ নেই। গুহার প্রবেশমুখের ভিতর দিয়ে সামান্য সূর্যের আলো ভিতরে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পড়ছে। এতে গুহার ভিতরটার খুব সামান্য অংশ আলোকিত হলেও ভিতরের দিকের পুরোটাই অন্ধকার। (এখন অবশ্য বৈদ্যুতিক আলো দিয়ে আলোকিত করে রাখা হয়েছে)। এত অন্ধকারের মধ্যে কি করে ভিতরে পাথর কাটাকুটি করা হয়েছিল তা এক বড় বিস্ময় হয়ে রয়েছে। গুহার ভিতরে মশাল বা অন্য কোন আলোর সোর্স দেখা যায়নি। হাতি ঘোড়াসহ বিভিন্ন ধরনের যেসব চিত্রকর্ম করা হয়েছে সেগুলোর নির্মাণশৈলী অসাধারণ। অন্ধকারে বসে এমন নির্মাণশৈলী অসম্ভব। অসাধারণ সব আয়োজন গুহার ভিতরে থাকার ফলে এক একটি গুহা যেন বিস্ময়ের এক একটি মহাসাগর। হাজার হাজার ফুট পাথর কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছিল এসব গুহা। কিন্তু কেন?

গুহাগুলো আবিস্কার করা হয়েছে নব্বইর দশকের শুরুতে। বড় ধরণের এক বন্যা থেকে বাঁচতে মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল পাহাড়ে। বন্যা কমে গেলে এখানে পানি ভর্তি গুহাগুলোর মানুষের চোখে পড়ে। পরবর্তীতে পানি সেচ করে এক একটি গুহা আবিস্কার করা হয়। গুহাগুলো আবিস্কারের পর চীনের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নানাভাবে কাজ করেছে। কিন্তু কোনভাবেই গুহা নির্মাণের রহস্য উদ্ধার করতে পারেনি। পারেনি বহু কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিশেষজ্ঞরাও বহুভাবে অনুসন্ধান করেছেন। রাতে দিনে কাজ করেছেন। কিন্তু গুহার রহস্যের কুলকিনারা করতে পারেননি। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছে যে, এক হাজার মানুষ টানা ছয় বছর পরিশ্রম করলে এমন একটি গুহা তৈরি করা সম্ভব। এক হাজার মানুষের ছয় বছর! এই এক হাজার মানুষ থাকলো কোথায়, খেলো কি. অন্ধকারে কাজই বা করলো কি করে? এই ধরনের অসংখ্য গুহা রয়েছে এখানে। ইতোমধ্যে ২৮টির মতো গুহা আবিস্কার করা হয়েছে। ২৮টি গুহা তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ কারা করলো, কিভাবে করলো! কে জানে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপবৃত্তি-পছন্দমতো এমএফএস অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রভার ‘কাউন্টডাউন’ শুরু.