পরস্পরের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাতের তীর ছুঁড়ে আলাদা হয়ে যাওয়া জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন আবারো এক হচ্ছে। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের আগ দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘কোঅর্ডিনেশন’ যুক্ত করে জন্ম দেয়া হচ্ছে নয়া সংগঠন। আগামী ২৩ এপ্রিল থেকে সকল বিবাদ ভুলে এবং অভিযোগ তুলে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করবে বিডব্লিউটিসিসি। নগর আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মধ্যস্থতায় বিবাদমান জাহাজ মালিক নেতারা একজোট হতে যাচ্ছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। অবশ্য শত শত কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ভুলে জাহাজ মালিকদের নেতৃবৃন্দের এক টেবিলে বসা নিয়ে শিপিং সেক্টরে বেশ কানাঘুষা চলছে।
সূত্র জানায়, বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানিকৃত কোটি কোটি টন ভোগ্যপণ্যসহ নানা পণ্য নিয়ে আসা জাহাজ থেকে বহির্নোঙরে পণ্য খালাস করা হয় লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে। দেশব্যাপী পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্কের অনেকটা লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরের উপর নির্ভর করে। লাইটারেজ জাহাজ চলাচলে শৃঙ্খলা আনায়ন এবং অসম প্রতিযোগিতা দূর করতে জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন মিলে গঠন করা হয় ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল বা ডব্লিউটিসিসি। চট্টগ্রাম চেম্বারকে সাথে নিয়ে যৌথভাবে এই সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছিল ২০০৩ সাল থেকে। জাহাজের সিরিয়াল দেওয়ার কাজটি তখন থেকে ডব্লিউটিসি করে আসছিল। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বেসরকারি এই সংস্থার কার্যক্রম নিয়ে নানা অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ চলতে থাকে।
এক পর্যায়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ আনা হয় ডব্লিউটিসির নেতাদের বিরুদ্ধে। অপরদিকে ডব্লিউটিসি আইভোয়াকের কয়েকজন নেতা সাধারণ জাহাজ মালিকদের ৫শ কোটিরও বেশি টাকা আত্মসাতের জন্য আটকে রেখেছে বলে অভিযোগ করে এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে জাহাজ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়। পরস্পরের প্রতি অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মাঝে ডব্লিউটিসিতে থাকা জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের একটি ইংল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) গত ১৯ নভেম্বর ডব্লিউটিসি থেকে বের হয়ে যায়। পরবর্তীতে আইভোয়াক নিজেরা একটি সেল গঠন করে জাহাজ বরাদ্দ দেয়া শুরু করে।
বিষয়টি আদালত এবং সরকারের বিভিন্ন পর্যায় পর্যন্ত গড়ায়। পরবর্তীতে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মাকসুদ আলমের সভাপতিত্বে বৈঠক হয়। উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠক থেকে ডব্লিউটিসি এবং আইভোয়াককে পৃথক সেল থেকে জাহাজ বরাদ্দ দেয়া বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়ে মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের মূখ্য কর্মকর্তাকে প্রধান করে সেল গঠন করে দেয়া হয়। তিনটি সংগঠন থেকে দুইজন করে প্রতিনিধি রাখা হয় সেলে। ওই সেল মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের মূখ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জাহাজ বরাদ্দের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ডব্লিউটিসি ওই সেল থেকে জাহাজ বরাদ্দের কার্যক্রম শুরু করলেও আইভোয়াক তাতে যোগ দেয়নি।
জাহাজ বরাদ্দসহ সার্বিক কার্যক্রমে বিরোধ চলতে থাকে। সাধারণ জাহাজ মালিকেরা জাহাজ নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যান। জাহাজ ভাড়া ব্যাপকহারে কমে যায়। যে যেভাবে পারছিলেন আমদানীকারকদের সাথে দর কষাকষি করে পণ্য পরিবহন করছিলেন।
বিদ্যমান বিরোধের মাঝে বিবাদমান দুই পক্ষ আবারো একই প্লাটফরমে যোগ দিয়ে একই সিরিয়াল থেকে জাহাজ বরাদ্দ শুরু করার উদ্যোগ নেয়া হয়। অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ ভুলে দুইটি পক্ষই আবারো একজোট হয়েছে। আগামী ২৩ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল নামের প্ল্যাটফরম থেকে জাহাজ বরাদ্দ শুরু করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এতে সংগঠনের নামে কিছুটা পরিবর্তন এনে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল গঠন করা হয়। নতুন নামে নতুন অফিসে নতুন ব্যবস্থাপনায় জাহাজ পরিচালনার কাজ চালানোরও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে ১৩ সদস্যের কমিটি। যাতে জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন তথা বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (বিসিভোয়া), ‘কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (কোয়াব)’ এবং ‘ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক)’ এর প্রতিটি থেকে ৩ জন করে ৯ জন এবং পণ্যের এজেন্ট এবং লোকাল এজেন্ট থেকে ২ জন করে ৪ জন সদস্য নেয়া হয়েছে। পুরো ব্যাপারটিই সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের উদ্যোগে হয়েছে বলে আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ২৩ এপ্রিল নতুন নামে নতুন ব্যবস্থাপনায় নতুন অফিস থেকে সংস্থার কার্যক্রম চলবে।
বিসিভোয়ার সাধারণ সম্পাদক এবং ডব্লিউটিসির কনভেনর মোহাম্মদ নুরুল হক জানান, দেশের পণ্য পরিবহন নেটওয়ার্ক যাতে ভেঙ্গে না পড়ে, ডব্লিউটিসি যেনো ভেঙ্গে বিশৃক্সখলা সৃষ্টি না হয় সে জন্য সরকার সচেষ্ট ছিল। সংকট সুরাহার জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহোদয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সকলের ঐকান্তিক চেষ্টা ছিল। সরকারের ইচ্ছের প্রেক্ষিতে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন পুরো বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা প্রায় প্রতিদিনই মিটিং করেছি। আলাপ আলোচনা করেছি। অবশেষে আমরা সবকিছু চূড়ান্ত করে ২৩ এপ্রিল থেকে কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগগুলো সুরাহা হয়ে গেছে বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থে এই উদ্যোগ জরুরি ছিল।