দুই বছরে বাংলাদেশ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) দশ হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে নিয়ে নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনে আহরিত ভ্যাট, শুল্ক ও আয়করসহ সরকারি রাজস্বের বাইরে নিজস্ব তহবিল থেকে এই টাকা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বিপিসির কর্মকর্তারা। তারই অংশ হিসেবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে চলতি অর্থবছরের শেষ কিস্তির এক হাজার কোটি টাকার চেক নির্দেশিত হিসেবে জমা দিয়েছে দেশে রাষ্ট্রীয় জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে এসব অর্থ কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বিপিসিকে পত্র দেয় অর্থ বিভাগ। এদিকে এসব অর্থ সরকারি কোষাগারে নিয়ে যাওয়ার কারণে ভবিষ্যতে তেল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে বিপিসি আর্থিক জটিলতায় পড়তে পারে বলে আশংকা সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল কর্পোরেশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নিতে একটি আইন করে সরকার। ২০২০ সালের গত ৫ ফেব্রুয়ারি আইনটি পাস হয়। মূলত সরকারের ব্যাংক ঋণের বোঝা বেড়ে যওয়ার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় স্বশাসিত ৬১টি প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে স্থিতি থাকা দুই লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা উন্নয়নের কাজে লাগানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আইনটি করা হয়। আইনটি পাসের পর গতবছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রায়াত্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ কিভাবে কোষাগারে নেওয়া যাবে সেজন্যে চার সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি ওই কমিটি ৬১টি সংস্থায় সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দেয়।
সূত্রে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ে গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি এসব স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার অর্থ কোষাগারে নেওয়া সংক্রান্ত একটি সভা হয়। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরের দিন (২৬ ফেব্রুয়ারি) মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক উপ-সচিব স্বাক্ষরিত পত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আপাতত ৫ হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য বিপিসি চেয়ারম্যানকে পত্র দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। একইভাবে চলতি অর্থবছরেও পাঁচ হাজার কোটি টাকা জমা দেওয়ার জন্য চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট পত্রসূত্রে জানা গেছে, ‘স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল কর্পোরেশনসহ স্ব-শাসিত সংস্থাসমূহের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন-২০২০’ এর ধারা ৪ ও ৫ এর বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কপোরেশন (বিপিসি) এর তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থের প্রথম কিস্তি ‘কোয়াসি কর্পোরেশনের উদ্বৃত্ত আয়’ কোডে জমা প্রদানপূর্বক চালানের কপি অর্থ বিভাগে প্রেরণ করতে বলা হয়েছে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বিপিসির শতভাগ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বর্তমানে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার এসপিএম প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার ইআরএল-২ প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে। তাছাড়া দেড় হাজার কোটি টাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম জ্বালানি তেল সরবরাহের পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিপিসি। চট্টগ্রামে বিপিসির প্রধান কার্যালয় নির্মাণের প্রকল্পও হাতে নিয়েছে বিপিসি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইনের জন্য প্রায় ১১শ কোটি টাকার বেশি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে প্রদান করা হয়েছে। ইআরএল-টু এখনো শুরু হয়নি। এটির ভৌত কাঠামো নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হলে বড় অংকের তহবিলের প্রয়োজন হবে বিপিসির।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদা মেটাতে তেল আমদানি করে থাকে বিপিসি। তেল আমদানির জন্য ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হয়। এজন্য প্রতিমাসে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার তারল্যের প্রয়োজন হয়। বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পগুলোর জন্য এখনো ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে বিপিসির। তাই বিপিসির নিজস্ব তহবিল থেকে সরকারি কোষাগারে নিয়মিত টাকা নিয়ে যাওয়া হলে আগামীতে তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংকটে পড়বে বিপিসি। বিশেষ করে নিজস্ব তহবিলের (অর্থের) সহজলভ্যতা না থাকলে আন্তর্জাতিক ক্রান্তিকালীন কোন মুহূর্তে জ্বালানি আমদানির জন্য এলসি করতে বিপিসিকে বিপাকে পড়তে হতে পারে।’
বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) এ টি এম সেলিম গতকাল সোমবার দুপুরে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘জাতীয় সংসদে পাস করা আইনের বলে রাষ্ট্রায়ত্ব স্বায়ত্বশাসিত অনেক প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার কোটি টাকা করে পাঁচ কিস্তিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। চলতি অর্থবছরেও পাঁচ হাজার কোটি টাকা অর্থ বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রদান করা হয়েছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষ কিস্তির এক হাজার কোটি টাকা ট্রেজারির নির্ধারিত হিসেবে জমা দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তেল আমদানির প্রয়োজনীয় তারল্য বিপিসির রয়েছে। চলমান প্রকল্পগুলোর জন্যও বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সরকার প্রয়োজনে বিপিসির অব্যবহৃত তারল্য কোষাগারে নিয়ে যাচ্ছে। সামনে বিপিসির প্রয়োজনে চাহিদা দিলে নিশ্চয়ই সরকার বরাদ্দ দেবে। এতে জটিলতার কিছু নেই।’