দিনভর দুর্ভোগ, বিকালে প্রত্যাহার

পরিবহন ধর্মঘট ।। নগরে বাস ভাঙচুর, চালককে মারধর, হাতাহাতি, ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

দিনভর মানুষের চরম দুর্ভোগের পর দাবি বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকের আশ্বাসের পর গতকাল রোববার বিকালে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। তার আগে পর্যন্ত দুর্ভোগের পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন মোড়ে ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে বাস ভাঙচুর, চালককে মারধর, পুলিশের সাথে হাতাহাতি, বাস চলাচলে বাধা দানের পাশাপাশি ছিল রিকশাসিএনজি টেক্সি চালকদের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়। বিকাল তিনটা থেকে আড়াই ঘণ্টা মালিকশ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে তাদের উত্থাপিত দাবি চারটি মেনে নেওয়ার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) তিন শিক্ষার্থী হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গাড়ি পোড়ানোর প্রতিবাদসহ ৪ দফা দাবিতে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জেলায় গতকাল ভোর ৬টা থেকে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল বৃহত্তর চট্টগ্রাম গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। ধর্মঘট চলাকালীন একদিকে তীব্র গরম, অন্যদিকে গাড়ি সংকটের জন্য ক্ষোভ ঝেড়েছেন সাধারণ মানুষ। গতকাল সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন মোড় ঘুরে দেখা গেছে, শিশু, বৃদ্ধ, স্কুলকলেজ শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষের দুর্ভোগ। আগুন ঝরা রোদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও গাড়ি পাচ্ছেন না যাত্রীরা। গতকাল থেকে খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। তবে সড়কে গণপরিবহন সংকটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। সড়কে নিয়মিত চলা গণপরিবহনগুলো বন্ধ হওয়ার সুযোগে বাড়তি ভাড়া হাতিয়ে নেয় রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল রাইডাররাও।

নগরীর মুরাদপুর, চকবাজার, বহদ্দারহাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, অক্সিজেন, নিউ মার্কেট, জিইসি, অলংকার মোড়, টাইগারপাসসহ বিভিন্ন স্থানে তীব্র গরমের মধ্যে গাড়ি না পেয়ে মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। শাহ আমানত সেতু এলাকায় হাজার হাজার যাত্রী তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে বাসের জন্য। তবে বাসের দেখা নেই। বাস না থাকার সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায় করে অন্য যানবাহনগুলো। সেই গাড়িগুলোতেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। গাড়ি না পেয়ে অনেকে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা হন। কেউ অতিরিক্ত ভাড়ায় অন্য কোনো বাহনে চাপেন।

নগরীতে সড়কে কিছু গণপরিবহন দেখা গেলেও সেগুলো চলাচলে শ্রমিকরা বাধা দেয় বলে অভিযোগ ছিল। শাহ আমানত সেতু এলাকায় এক বাস চালক জানান, সকালে বাঁশখালী থেকে যাত্রী নিয়ে আসার পর শাহ আমানত সেতু এলাকায় তাদের বাসটি আটকে দিয়েছে ধর্মঘটকারীরা। সেখানেই দেখা হলো রহিম উল্লাহর সঙ্গে। তিনি পরিবারসহ বাঁশখালী যাবেন। সেতু এলাকায় এসে দেখেন, গাড়ি চলছে না। তিনি বলেন, বাস চলবে না এটা আগে জানতাম না। এখন পরিবার নিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না। সিএনজি টেঙি দ্বিগুণ ভাড়া চাচ্ছে।

পটিয়া যাওয়ার জন্য সেতুর মুখে অপেক্ষারত শত শত নারীপুরুষ। বাস না চলার সুযোগে সিএনজি টেঙি ও মোটরসাইকেলের ভাড়া বেড়েছে। মোটরসাইকেলে একজন পটিয়া পর্যন্ত ২০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। অথচ অন্য সময় নেওয়া হয় ১৫০ টাকা। সিএনজি টেঙিতে একই গন্তব্যে প্রতিজন ১৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। সাধারণ লোকজন পিকআপ, ট্রাক, সিএনজি টেঙি, টমটম, ভ্যানগাড়িতে স্বল্প দূরত্বে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। একইভাবে এসব উপজেলা ও জেলা থেকে চট্টগ্রামমুখী মানুষকেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

সকালে নতুন ব্রিজ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, আমিরাবাদগামী যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও বাস পাচ্ছেন না। তবে গুটিকয়েক মাইক্রোবাস থাকায় তাতে করে কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে শহর ছাড়ছেন তারা।

ধর্মঘট চলাকালীন অঙিজেন মোড় এলাকায় বাস চালানোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাস ভাঙচুর, চালক ও শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়।

বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা বলেন, সকালে অঙিজেন মোড় এলাকায় আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী পরিবহনে ব্যবহৃত বিআরটিসির একটি বাস ভাঙচুর, চালক ও শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনার পর থেকেই ওই এলাকায় আমাদের থানা থেকে এক প্লাটুন পুলিশ এবং একটি পেট্রোলিং টিম মোতায়েন ছিল। তিনি বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। অভিযোগ পেলে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এর আগে, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অঙিজেন মোড় ট্রাফিক পুলিশ বঙের অদূরে আইআইইউসি ছাত্রছাত্রীদের পরিবহনে ব্যবহৃত একটি বিআরটিসি বাস থামায় পিকেটাররা। এ সময় বাইরে থেকে ২০ থেকে ২৫ জন যুবক এসে চালককে মারধর শুরু করে। বাসে ছাত্রছাত্রীরাও ছিল। সাথে সাথে পুলিশ এসে পিকেটারদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় পুলিশের সাথে শ্রমিকদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।

এদিকে গতকাল বিকাল ৩টার দিকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে পরিষদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠক হয় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে। জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান, সিএমপির প্রতিনিধি অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার নোবেল চাকমা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাউজান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের প্রতিনিধি, বিআরটিসির সহকারী পরিচালক রায়হানা আক্তার উর্থি প্রমুখ।

সভায় দাবি তুলে ধরে সংগঠনের নেতারা বলেন, চুয়েটে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার বিচার আইনি প্রক্রিয়ায় হবে। তবে এর পরিপ্রেক্ষিতে গাড়ি ভাঙচুর ও পোড়ানো পরিবহন মালিকশ্রমিকদের ভোগান্তিতে ফেলেছে। চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে পুলিশ পরিবহন শ্রমিকদের হয়রানি করছে। উল্টো পুলিশ কোটি কোটি টাকা পরিবহন খাত থেকে চাঁদা নিচ্ছে।

বৈঠকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী মারা গেছে। তাদের সহপাঠীরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তা ব্লক করে কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা মারা গেছে তারা বিখ্যাত বিদ্যাপীঠের দুজন মেধাবী শিক্ষার্থী। দুর্ঘটনার পরপরই আমরা বসেছি। বাস মালিক, শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা সেই সভায় ছিলেন। চুয়েটের ভিসিও ছিলেন। সভায় ছাত্রদের পক্ষ থেকে ১০টি দাবি জানানো হয়েছিল, যার সাতটিই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পূরণ করবে। বাকি তিনটি দাবির মধ্যে ছিল চালককে গ্রেপ্তার করা। ওই চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন আমরা চাই ওখানকার পরিস্থিতি আগে শান্ত হোক। আর সড়কে চাঁদাবাজিতে যদি কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত থাকে, তার ব্যবস্থা পুলিশ নেবে। আপনারা অভিযোগ দেন। আর আপনারা কাপ্তাই রোডে গাড়ি চালান। আপনাদের নিরাপত্তা আমরা দেব। সার্বক্ষণিক পুলিশ সেখানে নিয়োজিত থাকবে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (অপারেশন) নোবেল চাকমা বলেন, মামলা প্রত্যাহারের যে দাবি তোলা হয়েছে সেটি আসলে তদন্তের আগে জানানো সম্ভব নয়। আর গাড়ি পোড়ানোর বিষয়ে মামলা কেউ করতে চাইলে করতে পারবে।

বিআরটিএ চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক রায়হানা আক্তার বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত দুই শিক্ষার্থীর মাথায় হেলমেট ছিল না। মোটরসাইকেলেরও নিবন্ধন ছিল না বলে আমরা জানতে পেরেছি। এছাড়া যে বাসটি মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছে, সেটা ছিল ফিটনেসবিহীন। চালকের লাইসেন্স ছিল না।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান বলেন, জেলা প্রশাসনের দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনার পর থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। নিরাপত্তার বিষয়টি সেখানে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। গাড়িগুলো যাওয়াআসার সময় সামনে পেছনে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ স্কোয়াড থাকবে।

বৈঠকে গণপরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী বলেন, গত সভায় জেলা প্রশাসক মহোদয় নিহত ও আহত ছাত্রদের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা সহায়তা দিতে বলেছিলেন। সেটা আমরা দিয়েছি। বাস চালককে পুলিশের কাছে নিজেরা হস্তান্তর করেছি। কিন্তু চুয়েটের ছাত্ররা এরপর আমাদের তিনটি বাস পুড়িয়ে দিয়েছে। তারা যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আমরা ওই তিনটি গাড়ির ক্ষতিপূরণ দাবি করছি। পাশাপাশি যারা গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। তিনটি গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় মামলা হওয়ার কথা, এখনো কেন মামলা হচ্ছে না? এখানে কোনো লুকোচুরি আছে কিনা? আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করছি। তবে যদি আবার একই ঘটনা ঘটে, পুনরায় ধর্মঘট ডাকা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহেলমেট ছিল না চুয়েটের ২ শিক্ষার্থীর, যার ছিল তিনি বেঁচে গেছেন
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে পাহাড়ি সড়কে মটর সাইকেল যাত্রীদের মারধর ও টাকা ছিনতাই