শৈশবে আমি তাকে করবী নামে চিনতাম। বেগুনীরঙা ফুলগুলোর তেজপাতার মতো পাতা ছিলো। আজও সেই নামেই আমি তাকে চিনি, ভালোবাসি। দীর্ঘদিন তার অদর্শনে তাকে ভুলতে বসেছিলাম বলা যায়, তবে পুরোপুরি ভুলেছি তাও আবার বলা যায়না। কেমন যেনো ফেলে আসা আবছা অতীতের মতোন, ছায়া ছায়া থাকা, ভীষণ আলোর মাঝে।
উত্তর – পুবের কোণা বরাবর যে দিকটায় একটা টলটলে জলের পুকুর আছে,তার পুরো পাড় জুড়ে সবুজ ঘাস আর ঘাস। এতটাই বেশি ঘন, অনায়াসে তাতে লুকোচুরি খেলা যায়। ফাঁকে ফাঁকে গুল্মলতা জাতীয় কিছু গাছ। আশৈশব এই পুকুর নিয়ে নানা গল্প,কল্পকথায় এতটাই মত্ত থেকেছি, কখনো সাহস করে এত সুন্দর টলটলে জলে পা ভেজানোর মতো দুঃসাহস দেখাতে পারিনি। সে আফসোস এজীবনে আর শেষ হবার নয়। খুব ভয়ে ভয়ে যদিও যাওয়া হতো,তাও নির্দিষ্ট কিছু সময়ে, অভিভাবক সমেত। যাই হোক, ঠিক অতি সামপ্রতিক সময়ে সমুদ্র দেখতে গিয়ে কঙবাজার – ইনানী সড়কের পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে দেখা পেলাম সেই ছায়া সুন্দরীর। যার প্রকৃত নাম ‘দাঁতরাঙা’! প্রচুর ভাঁটফুলের সাথে তিনিও সমানে বিরাজমান সেই পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে। তার সাথে পিছিয়ে নেই অবেলার কাশফুল।
তিনিও দুলছেন বসন্ত বাতাসে! ইচ্ছে ছিলো গাড়ি থামিয়ে তাদের সেই বসন্ত বাতাসের দুলুনির শরীক হই। কিন্তু তা আর করা গেলোনা। তবে দু‘চোখে যতটা ধারণ করা যায়, তাতে কৃপণতা করিনি। সে এক অন্যরকম মুগ্ধতা! প্রিয়কে দূর থেকে দেখে চোখের শান্তি আনার মতো,না ছুঁয়েও ছুঁয়ে থাকার মতো। কানে কানে ভালোবাসি বলতে না পারলেও ভালোবাসাটুকু বাতাসে ছড়িয়ে দেবার মতো! খুউব ইচ্ছে করেছিলো, দু‘হাতের মুঠোয় পুরে তাকে ছুঁয়ে দেখি।এত এত বছরের বিরহ ঘুচুক, মুহূর্তের স্পর্শে! তার পরাগরেণুতে হাতের রং হয়ে উঠুক হলুদাভ! অথবা তার পাপড়িতে বুলিয়ে দেবো ভালোবাসাটুকু! হলোনা! তাকে ছুঁয়ে দেখার তীব্র বাসনায় মুখিয়ে ছিলাম,কিন্তু তা আর হয়ে উঠলোনা। তাকে করবী নামেই ডাকছি,কারণ তার এই আভিধানিক নামে আমার বেশ সমস্যা হচ্ছে,,ঠিকঠাক ভালোলাগাটুকু যেনো বোঝাতে পারছিনা তাকে। কেমন অদ্ভুত নিরীহ একটা ফুল, বসন্তেও ফোটে। বর্ষায়ও। একটু হাওয়ায়, জলে, বাতাসে, অনাদরে, আগাছার সাথে, ঘাসের বনে বেড়ে ওঠে—অনেকটা নামহীন, গোত্রহীন ফুলের মতো, বুনো ফুলের মতো। খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন জানতে চেয়েছিলো বুনো ফুল কেমন? ঠিক কোন ফুলকে বুনো ফুল বলা যায়? তাকে বলেছিলাম,অযত্নের সবই বনদেবী আপন মমতায় বুকে তুলে নেন। আর তখনিই তা বুনো হয়ে যায় হয়তো! এটা আমার ধারণা। বনদেবীর এই ভালোবাসাটুকু মাথায় নিয়েই রাস্তায়,বনে বাদাড়ে ফুটে ওঠে তারা,আলো করে দেয় সবটুকুদিয়ে, ভালোবাসাটুকুর কদর করতে জানে বলেই হয়তো! অথচ পরম যত্নে,আদরে, দামী টবে বাগান থেকে চারা কিনে সুন্দর সব বিদেশী নামের গাছ লাগিয়ে অপেক্ষা করছি, কবে ফুটবে সে! দিন, মাস, বছর পেরিয়ে আমরা হতাশ হই।
কারণ অথবা অজুহাত দেখাই নানারকম, ফুল না ফোটার। অথচ,জংলার পাড়ে অযত্নে লালিত এসব বুনো গন্ধের ফুলেরা কত কত ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করছে, তার খবর রাখে কে? এত এত বছর পর সেদিন “করবী” কে দেখে এক লহমায় মনে পড়ে গেলো সেই উত্তর–পুবের পুকুরটিকে। কত কত বছর সেই টলটলে জলে আকাশের ছায়া দেখা হলো না, ডালাভরে তোলা হলোনা সেই পুকুরপাড়ে অযত্নে ফুটে থাকা করবী ফুল। কত কতকাল! তবে ভালোবাসাটুকু বোধহয় এমনিই,মনের এককোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। শুধু একটু হাওয়া লাগার অপেক্ষা, অমনিই তা পেখম মেলে উড়ে যায়… আজ এত বছরের বিরহ শেষে করবীকে যখন দেখলাম,তুচ্ছ হলো এতদিনের বিরহপর্ব। ম্লান মনে হলো এত আধুনিক, নব্য পরিচিত ফুলের সৌন্দর্যকে। আমার সেই ঘাসের ফাঁকে,আগাছার সাথে ফোঁটা করবীই যেন সেরা। তার গায়ের বুনো গন্ধে এখনও যে পুকুরের গন্ধ আছে,শাপলার গন্ধ আছে,জলের গন্ধ, শ্যাওলার গন্ধ, শটি ফুলের গন্ধে সে এখনও বেশ এগিয়ে অন্যদের চেয়ে।