দইজ্যার তলে চলে গাড়ি : কর্ণফুলীর তলদেশের নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল উদ্বোধনের মাধ্যমে আনোয়ারা–কর্ণফুলীসহ পুরো চট্টগ্রামের মানুষকে আনন্দে ভাসিয়েছেন। টানেলের উচ্ছ্বাসে ভাসছেন দুই পারের বাসিন্দারা।
গতকাল টানেল উদ্বোধনের পর আনোয়ারার কেইপিজেড মাঠের জনসভায় চট্টগ্রামবাসীকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি উপহার নিয়ে এসেছি। শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশ, এমনকি আঞ্চলিক সমৃদ্ধির হাব হবে এই টানেল। তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, দইজ্যার তলে চলে গাড়ি, মাইয়া যাবে বাপের বাড়ি। কথা দিয়েছিলাম, কথা রেখেছি। এখন আর ঝড়–বৃষ্টির ভয় নাই, চাইলেই নদী পার হওয়া যাবে। সেতু বেশি হলে কর্ণফুলীতে পলি জমে নদীর ক্ষতি হবে। তাই সাহসী এই উদ্যোগ। আপনারা ভবিষ্যতেও আওয়ামী লীগের পাশে থাকবেন, দুই হাত ভরে উন্নয়ন পাবেন।
হলদে জনসমুদ্র : প্রধানমন্ত্রীর জনসভা উপলক্ষে কেইপিজেড মাঠে ভোর থেকেই ছিল মানুষের ঢল। সকাল ৮টার মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। হলূদ গেঞ্জি ও হলুদ টুপি পরে সমাবেশে যোগ দেন ভূমিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সমর্থকেরা। আনোয়ারা উপজেলা চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে বলেন, হলুদময় মাঠ দেখুন, জাবেদ ভাইয়ের শক্তি দেখুন। এরাই আওয়ামী লীগের প্রাণভোমরা।
পৌনে ১টায় প্রধানমন্ত্রী যখন জনসভা মঞ্চে আসেন তখন পুরো মাঠ যেন হলদে জনসমুদ্র। প্রধানমন্ত্রীর সামনে বক্তৃতায় ভূমিমন্ত্রী সমবেত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ভোর ৬টা থেকে তপ্ত বালিময় মাঠে এরা বসে আছে প্রধানমন্ত্রীকে একটু দেখার আশায়। এই ভালোবাসা শুধুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য।
৭৪ বছরের আবু তালেব : সকাল ৭টার দিকে বরুমচড়া থেকে এসে প্রায় এক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে জনসভাস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন ৭৪ বছর বয়সী আবু তালেব। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। এত কষ্ট করে কেন জনসভায় এলেন? তিনি বলেন, পানির নিচদি গাড়ি চলিবু। আজব কারবার। বললেন, একাত্তর সালে স্বাধীনতা ঘোষণার সময় যে আনন্দ পেয়েছি, আজ টানেল উদ্বোধনে ঠিক সেইদিনের মতো আনন্দ পেয়েছি।
ওবায়দুর রশীদ (৬৫) এসেছেন কঙবাজার থেকে। এতদূর থেকে আসা যেন সার্থক হলো। জানালেন, টানেল দেখেননি, টানেলের রাস্তার কিছু অংশ গাড়িতে চড়ে এসেছি। কী সুন্দর! বিদেশ বিদেশ লাগে।
প্রবাসীরা খুশি : জনসভায় যোগ দিতে আসেন আনোয়ারার চাপাতলি গ্রামের ওমান প্রবাসী কাজী মোরশেদ। গ্রামের বাড়ি থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের পথ বিমানবন্দর, কিন্তু মাঝখানে কর্ণফুলীর মোহনা। জানালেন এখন আর নদী পারাপারের ভয় নেই। ঝড়–বৃষ্টির চিন্তা নেই। মুহূর্তের মধ্যে টানেল পার হয়ে শাহ আমানত বিমানবন্দরে যেতে পারবেন।
টানেল সংযোগ সড়কে বাঁশি বাজিয়ে আনন্দ করছিলেন ৫০ থেকে ৬০ তরুণ। তাদের একজন মামুনুল ইসলাম। এসেছেন আনোয়ারার ডুমুরিয়া থেকে। উচ্ছ্বসিত মামুন বলেন, কালের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। নেভাল আর পতেঙ্গা সৈকতে যাওয়া এখন কয়েক মিনিটের ব্যাপার। কী যে আনন্দ, বলে বোঝাতে পারব না।
২৪ বছর পর কেইপিজেডে প্রধানমন্ত্রী : ২৪ বছর আগে এই অক্টোবরে সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেইপিজেডের ভিত্তি স্থাপন করেন। কাকতালীয়ভাবে গতকাল তিনি যেখানে জনসভা করেন এর কাছেই ছিল সেই ভিত্তিফলক। সমাবেশও হয়েছে কেইপিজেডের মাঠে। এ উপলক্ষে গতকাল রপ্তানি প্রক্রিয়া জোনের সবগুলো কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ৩০ হাজারের বেশি কর্মী যোগ দেন প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচিতে।
কালুরঘাট সেতুর জন্য আকুতি : সমাবেশে বক্তৃতা করেন বোয়ালখালীর দুই জনপ্রতিনিধি। একজন ওই আসনের সংসদ সদস্য নোমান আল মাহমুদ, অপরজন পৌর মেয়র জহুরুল ইসলাম। দুজনে কালুরঘাটে একটি স্থায়ী সেতু নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানান।
ইজ্জতের লড়াই : কর্ণফুলী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ফারুক চৌধুরী বক্তৃতায় বলেন, এই জনসভা আনোয়ারা–কর্ণফুলীতে হওয়ায় এটি ছিল ভূমিমন্ত্রীর ইজ্জতের লড়াই। এক মাস ধরে নেতাকর্মীরা রাত–দিন পরিশ্রম করেছেন। পুরো মাঠে আজ হলুদ গেঞ্জি আর ক্যাপ দেখে মন ভরে গেছে। প্রধানমন্ত্রীকে দেখাতে পেরেছি, আনোয়ারা–কর্ণফুলীর মাটি জাবেদ ভাইয়ের ঘাঁটি।
রঙ–বেরঙের পোশাকে জনস্রোত : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা ঘিরে সকাল থেকেই জনসভা অভিমুখে রঙ–বেরঙের পোশাকে জনস্রোতের সৃষ্টি হয়। কেইপিজেডের জনসভাস্থলে পৌঁছতে আশপাশের সকল সড়ক, উপসড়কে ভোর থেকেই দেখা যায় জনস্রোত।
লাল, নীল ও হলুদ রঙের শাড়ি, টুপি ও গেঞ্জি পরে হাজার হাজার দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ নারী–পুরুষ প্রধামন্ত্রীর জনসভায় যোগ দিতে ছুটে যান। অনেকে ঢোল–তবলাসহ নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নেচে–গেয়ে জনসভার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এ সময় নেতাকর্মীদের মুখে স্লোগান ছিল, শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার; শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।
প্রধানমন্ত্রীর ২২ মিনিটের বক্তব্য : জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার সময় উপস্থিত সমাবেশে নীরবতা নেমে আসে। তার ২২ মিনিটের বক্তব্যের সময় সমাবেশ জুড়ে ছিল নীরবতা। বক্তব্যের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আপনাদের জন্য কয়েকটি উপহার নিয়ে আসছি। ‘এখন দইজ্যার তল দিয়ে গাড়ি চলে’ এ বলতেই হাততালিতে মুখর হয়ে ওঠে জনসভাস্থল।