তিন মাসে ১৬ বার সংঘর্ষ

আহত শতাধিক, ৭০ কক্ষ ভাঙচুর, বহিষ্কার ১২ জন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে কেন্দ্রের শোকজ

চবি প্রতিনিধি | রবিবার , ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বারবার পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগ। উপাচার্যের দপ্তর ভাঙচুর, শাটল অবরোধ, শিক্ষার্থীসাংবাদিককে মারধর ও হেনস্তা এবং শিক্ষক প্রার্থীকে মারধর ছাড়াও নানা কারণে গত তিন মাসে নিজেদের মধ্যে ১৬ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক গ্রুপউপগ্রুপগুলো। এসব কর্মকাণ্ডে দুইবার কারণ দর্শানের নোটিশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কেন্দ্র থেকে বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও বগির নামেই নিজেদের কর্মসূচি পালন করছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সভাসমাবেশমিছিল থেকে শুরু সব কর্মকাণ্ডে বগির রাজনীতি জড়িয়ে আছে। ক্যাম্পাস জুড়ে রয়েছে বগির নাম।

গত তিন মাসে ১৬ বার সংঘর্ষে আহত হয়েছে ছাত্রলীগের অন্তত শতাধিক নেতাকর্মী। সোহরাওয়ার্দী, আলাওল ও এফ রহমান হলের প্রভোস্ট কক্ষসহ প্রায় ৭০টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ১২ জনকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেছে প্রশাসন। ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতৃবৃন্দ। এসব কর্মকাণ্ডে একদিকে ছাত্রলীগের নাম খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাজে ব্যাঘাত ঘটছে, ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি।

গত ২ ডিসেম্বর চিকা মারাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ব্‌াধে শাখা ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক ভার্সিটি এক্সপ্রেস ও বিজয়ের একাংশ। রাতভর দফায় দফায় সংঘর্ষে এফ রহমান হলের প্রায় ৫০টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। আহত হয় অন্তত ২০ জন। এরপর ৫ জানুয়ারি শাটলের সিটে বসাকে কেন্দ্র করে রাতে সংঘর্ষে জড়ায় ভার্সিটি এক্সপ্রেস ও সিক্সটি নাইন। গভীর রাতে আলো নিভিয়ে চলা কয়েক দফা সংঘর্ষে আহত হয় ১০ জন। এ দুই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি কথা কাটাকাটির জেরে সংঘর্ষে জড়ায় সিক্সটি নাইন ও বিজয়ের একাংশ। সর্বশেষ হলের কক্ষ দখলকে কেন্দ্র করে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে সংঘর্ষে জড়ায় বিজয়ের দুই অংশ। দফায় দফায় গত পাঁচদিনে ৮ বার সংঘর্ষে জড়ায় দুইটি পক্ষ। এতে প্রভোস্টের কক্ষসহ প্রায় ২০টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শৃক্সখলা রক্ষায় দুই হলে চালানো হয়েছে তল্লাশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। ক্যাম্পাসে মোতায়েন রয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ।

ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডে হতাশা প্রকাশ করেছেন শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এম এ খালেদ চৌধুরী। তিনি আজাদীকে বলেন, প্রাণের সংগঠনের এসব কর্মকাণ্ড দেখলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। মনে খুব কষ্ট লাগে। আমরা শিবিরের বিরুদ্ধে লড়াই করে ক্যাম্পাসে এমন পরিবেশ এনেছি। সঠিক সময়ে নেতৃত্ব গঠন এবং নেতৃত্বে জট না থাকলে এমন সমস্যা হবে না বলে মনে করেন তিনি।

চবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতি দুই মেরুকরণে বিভক্ত। একটি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং অপরটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। এই দুইটি গ্রুপ আবার ১১টি উপগ্রুপে বিভক্ত। গত প্রায় আট বছরে চবি ছাত্রলীগের কমিটি হয়েছে মাত্র দুইবার। ২০১৫ সালের ২০ জুলাই আলমগীর হোসেন টিপুকে সভাপতি এবং এইচ এম ফজলে রাব্বি সুজনকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘাতের কারণে দুই দফা স্থগিতের পর ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর দেড় বছরেরও বেশি সময় পর ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই রেজাউল হক রুবেলকে সভাপতি এবং ইকবাল হোসেন টিপুকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। অপরদিকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ দুইবার বগির রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও এ নির্দেশনাকে বার বার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে উপগ্রুপগুলো। গ্রুপিং রাজনীতিতে সক্রিয় এমন কোনো অভিযোগ পেলে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতিসম্পাদক সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বললেও এখন পর্যন্ত এসব নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি তাদের। এছাড়া বিভিন্ন গ্রুপে রেষারেষি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অভিযোগে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনবার বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু প্রশাসনিক তৎপরতার অভাব ও শাখা ছাত্রলীগের উদাসীনতায় প্রতিবারই অমান্য হয়েছে বগিভিত্তিক গ্রুপিং রাজনীতি।

সভাপতিসাধারণ সম্পাদককে কেন্দ্রের শোকজ : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। গতকাল শনিবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অফিসিয়াল প্যাডে সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয়। এর আগে গত ১১ জানুয়ারি চবি শাখা ছাত্রলীগকে শোকজ নোটিশ কেন্দ্র ছাত্রলীগ।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ধারাবাহিক সাংগঠনিক বিশৃক্সখলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ ক্ষুণ্ন হওয়া, গঠনতান্ত্রিক কার্যক্রমের ব্যত্যয় ও পূর্বে প্রদানকৃত শোকজ নোটিশের জবাবের উপযুক্ত প্রতিফলন না হওয়ায় রেজাউল হক রুবেল ও ইকবাল হোসেন টিপু, আপনাদের বিরুদ্ধে কেন পরবর্তী সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার উপযুক্ত কারণ উল্লেখ করে লিখিত জবাব আগামী ৭ দিনের মধ্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।

সার্বিক বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু আজাদীকে বলেন, আমরা জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও আমরা বলেছি যারা বিশৃক্সখলা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু প্রশাসন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। যেসব জায়গায় আইনশৃক্সখলা ব্যাহত হচ্ছে, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হওয়ার আশক্সক্ষা রয়েছে, সেখানে প্রশাসন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেলকে কয়েকবার ফোন করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবির দুই হলে রাতভর তল্লাশি রামদা উদ্ধার
পরবর্তী নিবন্ধআওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী আশেক রসুল খান