“তারা আমার কথা না রেখে চলে গেছে”

সৌদি আরবে অগ্নিকাণ্ডে নিহত লোহাগাড়ার মিজান এবং মানিকের মা

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সাতকানিয়া | বৃহস্পতিবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:০৬ অপরাহ্ণ

“পাকা ঘরে ঘুমানোর স্বপ্ন আমার পূরণ হলো না। সারাজীবন খেটে মরেছি। সুখের দেখা পাইনি। বুদ্ধির পর থেকে একটানা ১৫ বছর অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করেছি। পরে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ভিটে বিক্রি করে এবং সুদে টাকা নিয়ে সৌদি আরবে গিয়েছিলাম। সেখানে টানা ২৬ বছর খেজুর বাগানে কাজ করেছি। খেটে মরেছি কিন্তু সুখের দেখা মিলেনি। আমার বিক্রি করা জমিতে নির্মিত ঘরে আমি ভাড়া দিয়ে থাকি। সুখের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু আমার শ্যালকের টাকায় দুই ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে ভুল করে আবারো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম।”
লোহাগাড়া সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ সুখছড়ি নাজির আলী পাড়ার ভাড়া বাসার একটি কক্ষে আজ বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে কান্না বিজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সৌদি আরবের মদিনায় সোফা কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া লোহাগাড়ার মিজানুর রহমান ও আরফাতুজ্জামান মানিকের বাবা সুলতান আহমদ।
সুলতান আহমদ এসব কথা বলতে বলতে অন্য কক্ষ থেকে ভেসে আসছিল মিজান এবং আরফাতুজ্জামান মানিকের মা হালিমা বেগমের কান্নার আওয়াজ। বিলাপ করতে করতে তিনি বলছিলেন, “পুত্রবধূর মুখ দেখা হলো না আমার। পুত্রবধূর রান্না করা খাবার খাওয়া হলো না। একই দিনে দুই ছেলের বিয়ে দেয়া হলো না। পাকা ঘরে ঘুমানোর স্বাদ আমার পূর্ণ হলো না। তার আগেই আমার বুক খালি করে আল্লাহর কাছে চলে গেছে মিজান আর মানিক।”
তিনি জানান, কিছুদিন আগে ছেলেদের সাথে মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল। তখন তাদের বলেছিলাম দুইজনকে একসাথে দেশে আসতে। একই দিনে দুই ছেলের বউকে ঘরে তুলব। কী আনন্দ! কথা শুনে দুইজনই খুশি হয়েছিল। তারা কথা দিয়েছিল আগামী দুই মাস পরে একসাথে দেশে আসবে। পাকা ঘর করবে। একই দিনে দুই ভাই বিয়ে করবে। আমাকে দুই পুত্রবধূর হাতের রান্না করা খাবার খাওয়াবে। কথা রাখেনি, তারা আমাকে ফাঁকি দিয়েছে। আমার কথা না রেখে মিজান-মানিক চলে গেছে। আর কখনো আসবে না। এসব কথা বলতে বলতে হালিমার আর্তচিৎকারে উপস্থিত সবার চোখে পানি ঝরছে। কোনোভাবেই তার কান্না থামানো যাচ্ছিল না। কোনো সান্ত্বনাই তার ছেলে হারানোর শোক ভুলাতে পারছে না।”
হালিমা বেগম বলেন, “দুই ছেলে বারবার বলেছিল আমাকে হজ্বে যাওয়ার জন্য। তাদের কথামতো পাসপোর্টও করেছিলাম। করোনার কারণে গতবারে যাওয়া হলো না। আশা ছিল আগামীবারে হজ্ব করতে যাবো। দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে হজ্ব পালন করব। আল্লাহ আমার সেই আশা পূরণ হতে দিল না। এর আগেই আমার বুকের মানিকদেরকে তার কাছে নিয়ে গেল। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব?”
সুলতান আহমদ বলেন, “ছেলেদের উপার্জিত এবং ধার করা টাকায় একটি ভিটেও কিনেছিলাম। তারা বলেছিল বিদেশ থেকে এসে সেই জায়গায় একটি পাকা ঘর করবে। আহ! আমি পাকা ঘরে ঘুমাব। না, সেই স্বপ্ন আমার পূরণ হবে না। এর আগেই আল্লাহ আমার বুক খালি করে দুই ছেলেকে আকাশে তুলে নিয়ে গেছে। আর ফিরবে না, আমার জন্য পাকা ঘর করতে পারবে না। আমার পাকা ঘরে ঘুমানোর স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না কারণ সুখ আমার কপালে সয় না।”
তিনি আরো বলেন, “গত এক বছর আগে দুই ছেলেকে সৌদি আরবে রেখে আমি দেশে চলে এসেছি। আমি টানা ২৬ বছর বিদেশে থাকলেও আমার টাকায় ছেলেদের নিতে পারিনি। তাদের মামার টাকায় সৌদি আরবে গেছে। ছোট ছেলে মানিক মামার দোকানে চাকরি করত আর মিজান একটি সোফা কারখানায় কাজ করত। গত এক মাস আগে তাদের মামার দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন মিজান তার ছোট ভাই মানিককে সোফা কারখানায় নিয়ে যায়। আর সেই সোফা কারখানায় পুড়ে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়।”
কিছুক্ষণ পরপর বিলাপ করতে করতে সুলতান আহমদ বলেন, “আমি সৌদি আরব থেকে আসতে চাইনি। আমার ছেলেরা জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেদিন তারা বলেছিল, জীবনে অনেক খেটেছো। এখন আমরা বড় হয়েছি। আর খাটতে হবে না। এখন দেশে থাকবে। আমরা টাকা পাঠাব আর তুমি ইচ্ছামতো খরচ করবে। নিজের পছন্দমতো একটি বাড়ি করবে। সেদিন তারা মাকে ফোন করে বলেছিল আমি দেশে আসার পর যেন আমার পাসপোর্টটি পুড়িয়ে ফেলে। পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেললে আমি আর বিদেশে যেতে পারব না। ছেলেদের কথামতো আমার স্ত্রী বারবার চেষ্টা করে পাসপোর্টটি পুড়িয়ে ফেলার জন্য কিন্তু আমি সেই সুযোগ দিইনি। আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে তারা না ফেরার দেশে চলে গেছে। আমার ছেলেরা আমাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে বুঝতে পারিনি। আমি এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমি আর বাঁচতে চাই না। এখন আমার শেষ ইচ্ছা সৌদি আরবে গিয়ে মরা যেখানে আমার ছেলেরা ঘুমিয়ে থাকবে সেখানে যাওয়া। তাদের পাশে ঘুমানো। সৌদি আরবে গিয়ে মরতে পারলে আমার আত্মা শান্তি পাবে। আমি আর কিছু চাই না।”

পূর্ববর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে দেশীয় এলজি কার্তুজসহ গ্রেপ্তার ১
পরবর্তী নিবন্ধবাকলিয়া থানা ছাত্রলীগের আহবায়ক কমিটিকে অবাঞ্চিত ঘোষণা