তাঁতশিল্প হল দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্প। শাড়ী, লুঙ্গি ও গামছা হল এই শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে বিশ্বজুড়ে এই শিল্পের চাহিদা ছিল অত্যধিক। তখন বাংলার পরিচয় ছিল পৃথিবীর তাঁতঘর হিসাবে। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝিতে মরোক্কোর পর্যটক ইবনে-বতুতা সোনারগাঁয়ের মসলিন দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন এমন চমৎকার ও উঁচুমানের কাপড় পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।
পঞ্চদশ শতকে অনেক চিনা পর্যটক ও ভিক্ষু বাংলার সুতি বস্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন এবং এমন মিহি কাপড় তাঁতিরা যে চরকা দিয়ে বানায় তা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ এই ট্যাগটি এই দেশে তাঁতিদের হাত ধরেই আসে। আদি বসাক সমপ্রদায়ের তাঁতিরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মোঘল আমলে এই শিল্পে হিন্দু মুসলমান উভয়ে পারদর্শী ছিল, এটা ছিল তাঁতশিল্পের স্বর্ণযুগ। সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের উৎসাহে বাংলার মসলিন ব্যাপক খ্যাতি পায়। তৎকালীন সময়ে ১৩ হাত লম্বা ও ২ হাত চওড়া এক খানি মসলিন কাপড় একটি দেয়াশলাই এর বাঙে অনায়াসে ভরে রাখা যেত। বাংলার প্রাচীন সাহিত্য ‘চর্যাপদে’ এই অঞ্চলের তাঁতিদের কথা উল্লেখ আছে।
কবির ভাষায় – বাংলার মসলিন, বাগদাদ, রোম, চীন/ কাঞ্চন তৌলেই কিনতেন একদিন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনকালে তাঁতবস্ত্র রপ্তানি পণ্য হিসাবে প্রাধান্য পায়। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পর বিজয়ী ইংরেজরা যখন এ দেশের শাসনভার তুলে নেয়, তাঁতশিল্পে তখন প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়। ইংল্যান্ডে তখন শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল। আর তার প্রভাব পড়েছিল তাঁতশিল্পের উপর। হাতে চালিত তাঁতশিল্প ধ্বংস করার এই ছিল এক বিশাল চক্রান্ত। ইংরেজরা ভারতবর্ষে কম দামে সুতা আমদানি করাতে ওদের সুতার চাহিদা বাজারে বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের তাঁতিরা পশুর লোম ও তুলা থেকে সুতা বানানোর যে পরিশ্রম, তা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। উপরন্তু ব্রিটিশরা এ দেশের তাঁতিদের বৃদ্ধাঙুলি কেটে দিয়ে নীল চাষে বাধ্য করায় এদেশের সর্ববৃহৎ কুটিরশিল্প তাতঁশিল্পের গৌরব ধীরে ধীরে ম্লান হচ্ছিল। ইংরেজরা বিতাড়িত হওয়ার পর তাঁতিরা পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে পড়ছিল। সুতা, রাসায়নিক দ্রব্য ও রঙের দাম বেড়ে গিয়েছিল কিন্তু তাঁতপণ্যের দাম না বাড়াতে ক্রয় বিক্রয়ে মন্দাভাব দেখা গিয়েছিল। তাঁতিরা ক্রমান্বয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছিল এবং তাত শিল্প হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল।
বাংলাদেশের রাজশাহী, টাঙ্গাইল কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতিদের জীবন ওই সময়ে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে এসেছিল। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসলে মুক্তিফৌজ গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ও নারীনেত্রী প্রীতিরানী দাশপুরকায়স্থ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে তাঁর কাছে তাঁতের তৈরি একটি উপহার পাঠান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আপ্লুত হয়ে প্রীতিরানী দাশকে নিজ হাতে লিখে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। যাতে উনি লিখেছিলেন- ‘শিল্পজগতে তাঁতশিল্প এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে বিশেষ করে বাংলাদেশের উন্নতমানের তাঁতশিল্প একটি গৌরবের বিষয়। দেশের ভাঙা অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রশ্নে আপনাদের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। সেহেতু আমাদের তাঁতশিল্পের ক্রমবিকাশ এবং বিশ্বের হস্তশিল্পাঙ্গনে এর সুপ্রতিষ্ঠিত স্থান আমার একমাত্র কাম্য। সরকার এই ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা করে যাবে’।
উনি তাঁতিদের সহজ শর্তে ঋণদান, তাঁতশিল্প সরঞ্জাম আমদানিতে আইন প্রণয়ন, তাঁতিদের উৎপাদিত সুতা হতে কাপড় বুননসহ বিভিন্ন প্রকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে কিছুসংখ্যক তাঁতি দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলেও বাকিরা অভাব, দুর্যোগ, বিপ্লব, দ্বন্দ, ও ঋণ এই সবকিছু মাথায় নিয়ে টিকে থাকার জন্য অকপটে লড়াই করে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর নিহত হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক পটভূমি পাল্টে গেলে তাঁতশিল্প টিকে থাকার লড়াইয়ে সুবিধা করে নিতে পারছিল না, বিশেষ করে লুঙ্গি ও গামছার তাঁতিরা। ১৯৯৪ সালে বিবি রাসেল খুব কাছ থেকে তাঁতিদের পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাঁতশিল্পকে বৈশ্বিক মানচিত্রে তুলে ধরার জন্য পরিকল্পনা নেন। তিনি কুটিরশিল্পের যাদুখ্যাত গামছাকে বহুমাত্রিক ব্যবহারের চিন্তা মাথায় নিয়ে ইউনেস্কোর সহায়তায় ইউরোপে তিনটি বড় শো করেন। তিনি গামছা দিয়ে – চুড়ি, শাড়ি, পর্দা, ন্যাপকিন, স্কার্ফ, সোফা কভার প্রভৃতি তৈরি করে ফ্রান্স, ইটালি, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিলে গামছার স্কার্ফ জনপ্রিয়তা পায়। স্পেনের রানী সোফিয়া, খ্যাতনামা গায়িকা ম্যাডোনা এবং অনেককেই স্কার্ফ ও চুড়ি ব্যবহার করতে দেখা যায়। আমরা জানি আমাদের এই শিল্পের কদর একদা মোঘল দরবার থেকে বৃটেনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল।
জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা তাঁতশিল্পের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার মধ্যে পদ্মাপাড়ে, শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ‘শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী’ গড়ে তোলার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। এর জন্য সরকার ১২০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। শরীয়তপুর অংশে ৬০ একর এবং মাদারীপুরের শিবচর অংশে ৬০ একর। ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করে এখন সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এটি ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডকে। এখানে থাকবে আবাসন ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, বাজারজাতকরণ, পণ্যের গুনগত মান উন্নয়নের ব্যবস্থা, দক্ষতা বৃদ্ধি, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, দেশীয় ও বিদেশী বাজারে তাঁতবস্ত্র সরবরাহের ব্যবস্থা, সাইবার ক্যাফে, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ইত্যাদি। ১০লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিনিয়োগকারীরা আসবে ‘শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী ‘ তে এবং এটি একটি বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হবে। তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য বর্তমান সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। নারায়ণগঞ্জে তাঁতি সবচাইতে বেশি, তারপর সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও টাঙ্গাইল। আর জামদানি মানেই রূপগঞ্জ, তাছাড়া উল্লেখযোগ্য তাঁতবস্ত্রের মধ্যে রয়েছে মসলিন, মিরপুরের বেনারসী, মনিপুরী তাঁতবস্ত্র, রাজশাহী সিল্ক, কুমারখালির হাতের রুমাল, চাদর, বেড শিট ইত্যাদি। সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় ৫০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকায় তাঁত কারখানা রয়েছে প্রায় ১৪,৮৪৯টি,তাঁতি পরিবারের সংখ্যা ৪৬,৪০৩ এর কাছাকাছি। এই জেলার তাঁতশিল্প পুনরায় বিশ্ববাজারে পরিচিতি পাওয়ার জন্য এর নাম দেয়া হয়েছে ‘তাঁতকুঞ্জ সিরাজগঞ্জ’ করোনা মহামারীর কারণে কিছুটা স্থবিরতা আসলেও বর্তমানে জামদানী, রাজশাহী সিল্ক ও মসলিন পুনরায় দেশীয় বাজারে স্থান করে নিয়েছে। স্বল্প সুদে অর্থায়ন, ই-মার্কেটিং, ই-কমার্স ইত্যাদি সহযোগে উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে আমাদের তাঁতশিল্প অন্যতম রপ্তানিমুখী খাত হিসাবে বিবেচিত হবে।
তথ্যসূত্র : ১.বাংলাদেশের তাঁতশিল্প ও মুক্তবাজার অর্থনীতি- ড: মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক, ২. আলোকিত সিরাজগঞ্জ, ৩. বাংলাদেশের তাঁতশিল্প (বাংলা ট্রিবিউন)-হাসনাত নাঈম।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।