‘মৈমনসিংহ গীতিকা’’ এই শব্দবন্ধের সাথে যে নামটি অনিবার্যভাবে উচ্চারিত হয় সেই নামটি হলো আচার্য ড.দীনেশচন্দ্র সেন। দীর্ঘ বছর আমি ড.দীনেশচন্দ্র সেনকে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ এর সংগ্রাহক হিসেবে জানতাম। গীতিনাটক দেখেছিলাম ‘মহুয়াপালা’। খুব বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি এ বিষয়ে। গত ১৩ মে ২০২৩ চট্টগ্রাম এ আচার্য ড. দীনেশচন্দ্র সেনের স্মরণসভায় কিছু আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই সুবাদে তাঁকে জানার চেষ্টা করেছি। তথ্যসূত্র মতে দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৬৬’র ৩ নভেম্বর অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলার অন্তর্গত বকজুরি গ্রামে মাতুলায়ে জন্মগ্রহণ করেন। বহু প্রতিভার অধিকারী দীনেশচন্দ্র সেন একাধারে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক, পুঁথি সংগ্রাহক, লোক সাহিত্য বিশারদ, বাংলা সাহিত্য ইতিহাসকার, বহু গ্রন্থের প্রণেতা এবং রায় বাহাদুর উপাধি প্রাপ্ত। তাঁর শিক্ষা জীবন এ বঙ্গেই। পারিবারিক কারণে অসময়ে জীবিকার অন্বেষণে শিক্ষকতা শুরু করেন। ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লার বিভিন্ন স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। চাকরির পাশাপাশি পড়ালেখাও চালিয়ে যান। অধ্যয়নের বিষয় ইংরেজি সাহিত্যে ১৮৮৯ সালে অনার্স সহ বি.এ পাশ করেন। পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাও চলতে থাকে। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে সাহিত্যপ্রীতির আভাস পাওয়া যায়। মাত্র ৭ বছর বয়সে তিনি সরস্বতীর স্তব লিখেছিলেন যা তৎকালীন ”ভারত সুহৃদ”, ”নবজীবন” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং বিপুল প্রশংসা অর্জন করেছে। তাঁর আত্মজীবনী ‘‘ঘরের কথা ও যুগ সাহিত্য’’ এ তিনি লিখেছেন, বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হইব, তা যদি হতে না পারি, প্রতিভায় না কুলায় তবে ঐতিহাসিকের পরিশ্রমলব্ধ প্রতিষ্ঠা হইতে আমায় বঞ্চিত করে কার সাধ্য?’ তাঁর ঐতিহ্য প্রীতি, অতীতের প্রতি অনুরাগ ও সনিষ্ঠ ইতিহাস চেতনা তাঁকে এক যুগন্ধর সাহিত্য–ঐতিহাসিকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর নিজের ভাষায় তিনি একজন ‘বঙ্গভাষার সেবাব্রতী’। বছরের পর বছর অনাহারে,অর্ধাহারে থেকে পূর্ববঙ্গের পল্লি গ্রাম ঘুরে বাংলা পুঁথি, লোক সাহিত্য ও লোক গীতি সংগ্রহ, সংকলন ও প্রকাশ করেছেন। তৎকালে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের বাংলার সাহিত্য চর্চার প্রতি অনিহা ছিল। দীনেশচন্দ্র সেন এর ব্যতিক্রম। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় তিনি হাতে পেয়েছিলেন হাতে লেখা অনেক প্রাচীন পুঁথি। বহু কষ্ট স্বীকার করে তিনি এ রত্ন উদ্ধার করেছিলেন। প্রাচীন সাহিত্যে নিরন্তর অনুশীলন তাঁকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে পুঁথি সংকলনে উৎসাহী করে তুলেছিল। প্রায় ১৯ বছর তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবা করেন। তাঁর অসাধারণ কীর্তি ‘‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বইটি পড়ে অভিভূত হন। তিনি দীনেশ চন্দ্র সেনকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছিলেন যা দীনেশচন্দ্রের লেখা ‘‘রামায়ণী কথা’’ এর মুখবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উল্লেখ করেছেন।
তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহে তিনি ১৯০৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Special University Professor’ পদে যোগ দেন।শর্ত অনুযায়ী তাঁকে বেশ কিছু বিষয়ে ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ বক্তৃতাগুলোর লিখিতরূপ ‘History of Bengali Language and Literature’ নামের গ্রন্থটি। এ গ্রন্থে প্রাচীন বাংলা সাহিত্য, চৈতন্যদেব, রামায়ণ ও লোক সাহিত্য বিষয়ক লেখা অন্তর্ভুক্ত। তাঁর বাগ্মীতা এবং বাংলা সাহিত্যে গভীর জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগ স্থাপনের বিষয়ে উৎসাহিত করেন। ১৯১৯ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রাথমিক ভিত গড়ে তোলেন এবং দীনেশচন্দ্র বিভাগের প্রথম অধ্যক্ষ এবং প্রফেসর হন । ১৯১৯ থেকে ১৯৩২ একটানা ১৩ বছর তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন । এ সময় তিনি ”রামতুনু লাহিড়ী’ ফেলোশিপ অর্জন করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গবেষণা ও বক্তৃতার জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে। ১৯২১ সালে বিশেষ অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সান্মানিক ডিলিট প্রদান করা হয় । ১৯৩২ সালে পান আশুতোষ–জননীর নামে প্রবর্তিত পুরস্কার ”জগত্তারিণী স্বর্ণপদক”।
রামতনু লাহিড়ী ফেলো হিসেবে তাঁর অন্যতম কাজ হোল পূর্ববঙ্গের পল্লী থেকে মুখে মুখে এতদিন ধরে প্রচলিত গীতিকা সমূহ উদ্ধার এবং সেগুলি সম্পাদনা করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করা । তিনি এ সংকলেনের নাম দেন ”মৈমনসিংহ গীতিকা”। একাজে যাঁরা তাঁকে সহায়তা করেন তাঁদের মধ্যে চন্দ্র কুমার দে, চট্টগ্রাম এর বিশিষ্ট লোকসাহিত্যিক আশুতোষ চৌধুরী, কবি জসিমউদ্দিন অন্যতম।বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা সময়ে বাঁকুড়া থেকে পুঁথি সংগ্রহ করে এনে দেন তাঁর গৃহ পরিচারক রামকুমার দত্ত। এ ছাড়া ত্রিপুরা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম থেকে সংগৃহীত পালাগুলি‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা” নামে প্রকাশিত হয়। ।পরবর্তীতে দীনেশচন্দ্র এ গীতিকা ইংরেজিতে র্তজমা করেন ‘Eastern Bengal Ballads’ এ নামে। ময়মনসিংহ গীতিকা মধ্যে মহুয়া পালা, মলুয়া পালা, কমলা পালা এবং রূপকথা কাজলরেখা গ্রন্থিত হয়েছে। পূর্ব মৈমনসিংহ থেকে এ গীতিকা সংগৃহীত হয়েছে। ১৬৫০ সালে মৈমনসিংহে মহুয়া পালা রচয়িতা হয় এবং মহুয়া পালার রচয়িতা দ্বিজ কানাই এবং সংগ্রাহক দীনেশ চন্দ্র সেন। মহুয়া পালা বেদের মেয়ে মহুয়া এবং নদের চাঁদের গভীর প্রনয় এর কাহিনী। এ প্রনয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে তাদের উভয়ের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। মহুয়া ও নদের চাঁদের এই আত্মত্যাগ চিরন্তন প্রেমকে মহিমান্বিত করেছে। দীনেশ চন্দ্র সেন ময়মনসিংহ গীতিকার প্রথম খন্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, মহুয়ার প্রেম নির্ভক, কি আনন্দপূর্ণ ! শ্রাবণের শতধারার ন্যায় অশ্রু আসিতেছে কিন্তু প্রেমের মুক্তাহার কণ্ঠে পরিয়া মহুয়া চিরজীবী, মৃত্যুকে বরণ করিয়া মৃত্যুঞ্জয় হইয়াছে।’ ‘মলুয়া পালা দীনেশ চন্দ্র সেনের আরেকটি সংগ্রহ। মলুয়া ও চাঁদ বিনোদের দাম্পত্য জীবন কিভাবে সমাজের ক্ষমতাবান মানুষের দাপটে দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল এবং তার কাছে হার না মানা এক বাঙ্গলি নারীর কাহিনী। মলুয়া চরিত্র সম্পর্কে দীনেশ চন্দ্র সেন মন্তব্য করেন ‘‘রাগে উজ্জ্বল বিরাগে উজ্জ্বল সহিষ্ণুতায় উজ্জ্বল’ এ মহিয়সীর প্রেমের তুলনা কোথায়? কমলা পালাটির রচয়িতা দ্বিজ ঈশান। রাজা জানকীনাথ মল্লিক তাঁর স্ত্রীর নামে দীঘি খনন করান। কিন্তু দীঘিতে জল না উঠায় রাজা নরকপ্রাপ্ত হওয়ার ভয় পেলে রাণী কমলা স্বামীকে উদ্ধার করতে গিয়ে দীঘিতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। রাণীকে হারানোর শোকে কিছুদিনের মধ্যে রাজা মৃত্যুবরণ করেন। কাজল রেখা মৈমনসিংহ গীতিকায় সংযুক্ত একমাত্র রূপকথা। এ পালার সংক্ষিপ্ত রূপ দক্ষিণা রঞ্জন মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলিতে জানা যায়। তথ্য মতে, এ পালাগুলি পূর্ব মৈমনসিংহ থেকে সংগৃহীত । এ গীতিকার নারী চরিত্রগুলির প্রতি দীনেশচন্দ্র অত্যন্ত সমবদেনাশীল এবং দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, ‘মলুয়া, মদিনা, কমলা, ঘাগড়া পরা বিদেশিনী নয়, শাড়ি পরা আমাদেরই ঘরের মেয়ে’। ময়মনসিংহ গীতিকার নারী চরিত্রগুলো রোমাঁ রোঁলাকে আকর্ষণ করেছে। তিনি লিখেছেন, ‘An antique beauty and purity of sentiment’ রোমাঁরোঁলা ফরাসি ভাষায় গীতিকাগুলি অনুবাদ করে বিশ্ববাসীকে এ বিষয়ে অবহিত করান। দীনেশচন্দ্র সেনের প্রদর্শিত পথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক–সংস্কৃতি, সাহিত্য চর্চায় আশুতোষ ভট্টাচার্য্য স্মরণীয় ভূমিকা রাখেন।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে হিন্দু মুসলমানের সমান অবদান রয়েছে কিন্তু মুসলমানের অবদান উপেক্ষিত হয়ে আছে। এ ভাবনায় দীনেশচন্দ্র সেন ‘‘প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান” এই গ্রন্থটি লেখেন । কবি জসীম উদ্দিনের পল্লীগান সংগ্রহেও তিনি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবি জসীম উদদীন লিখেছেন, ‘‘তুলোট কাগজের পুঁথিগুলি কয়েক শতাব্দি ধরে লাল কাঁথা মুড়ি দিয়ে যেন মরণঘুমে অচেতন ছিল। দীনেশচন্দ্র তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের সোনার কাঠি ছুঁয়ে তাদের জাগিয়ে তোলেন। নানা যুগের বাণী ও বার্তা এ পুঁথি সাহিত্যে নীরব হয়ে ছিল। দীনেশচন্দ্র যেন তাদের মূকত্বের অভিশাপ থেকে উদ্ধার করলেন।” তৎকালীন অবহেলিত, নির্যাতিত নারীর অবস্থা দেখে তিনি নারী প্রগতি ও নারী শিক্ষা বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। ‘‘বৃহৎবঙ্গ’’ তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তিনি একাধারে প্রাচীনসাহিত্য, বৈষ্ণবসাহিত্য, পৌরানিকসাহিত্য বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘বঙ্গবাণী’ ও ‘বৈদ্য হিতৈষিণী’ নামে পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করেছেন। বাংলা পল্লীসাহিত্যকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা তাঁর অসামান্য কীর্তি। ১৯৩৯’র ২০ নভেম্বের ‘‘বাংলাভাষা সেবাব্রতী” ড. দীনেশচন্দ্র সেন পরলোক গমন করেন। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাপ্রণতি নিবেদন করি।
লেখক : শিক্ষাবিদ; সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজ