যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন অন্তত ১০ কোটি মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এরইমধ্যে তা বুঝতে শুরু করেছে বিশ্ব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যানুয়ায়ী, ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারান প্রায় ২০ হাজার মানুষ। আর চলতি বছর বিশ্বে ৪০ হাজার মানুষ মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত ২২ জুলাই দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে ‘চলতি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত সাড়ে ৩শ ছাড়াল’ শীর্ষক প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। থেমে থেমে বৃষ্টি ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী। গত এক সপ্তাহে নগরীতে ভারী বর্ষণ না হলেও থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। এতে মশার প্রজনন বাড়ার আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে চলতি জুলাই মাসে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সাড়ে তিন শ ছাড়িয়ে গেছে। অনেক রোগী বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বিভিন্ন বেসরকারি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার বংশবিস্তারে সাহায্য করছে নগরায়ণও। কিছু স্থানে এই রোগ আগে ছিলো না কিন্তু এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এই প্রবণতা এখন বাংলাদেশ ও ভারতে দেখা যাচ্ছে। সাস্প্রতিক বছরগুলোতে ক্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ ইউরোপ, আফ্রিকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। কিন্তু জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই। কীটতত্ত্ববিদরা মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার কথা বলেন। এজন্য প্রথমত, চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। কেননা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মশা বেশি জন্মায়। দ্বিতীয়ত, জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে কোথায় কোথায় মশা বেশি, কোন ধরনের মশার উপদ্রব বেশি এবং এ মশার জন্য কোন ওষুধ কতটুকু ছিটাতে হবে, তা নির্ণয় করে ওই জায়গায় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। যেন এসব জায়গায় নতুন করে মশা জন্মাতে না পারে। এছাড়া মশার অতিরিক্ত প্রজনন বন্ধের জন্য জলাশয়ে মাছ, হাঁস ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, রাসায়নিক ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবশেষ সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ চারটিকে একত্রে কীটতত্ত্ববিদদের মতে ‘সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা’ বলা হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, আবহাওয়ার যে পরিস্থিতি তাতে এ বছর মশার উৎপাত গত বছরের চেয়ে বেশি হবে। মশা বাড়লে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়বে। তাঁরা বলেন, ডেঙ্গুতে ভর্তি রোগীর অনুপাতে মৃত্যু বেশি। মৃত্যু কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে সময় লাগবে, কিন্তু মৃত্যু কমানোর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সরকারি রেটে ডেঙ্গু পরীক্ষা সহজ করতে হবে। আক্রান্ত রোগীদের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারলে ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যা কমে আসবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ঢাকা শহরে বসবাসরতদের ঝুঁকি বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, রাজধানীর পাশাপাশি দেশের অন্যসব এলাকাতেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে। মনে রাখতে হবে পৃথিবী যতদিন থাকবে, ততদিন ডেঙ্গু থাকবে। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পদ্ধতি প্রয়োগ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। গবেষণা ও পর্যালোচনা করে স্থায়ীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নইলে দিনদিন সমস্যা বাড়তেই থাকবে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ থেকে আরও ভয়াবহ হবে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতির এতই অবনতি হবে যে, আগামীতে তা সামাল দেওয়া যাবে না।