চট্টগ্রামের সন্তান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নামে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়–এর নামকরণ করার দাবি উঠেছে। একইসঙ্গে তিনি হাটহাজারীতে ‘গণস্বাস্থ্য গরিবের হাসপাতাল’ গড়ার যে উদ্যোগ নেন সেটা চালুরও দাবি করা হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘নাগরিক স্মরণসভা ও চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের আত্মপ্রকাশ’ অনুষ্ঠান থেকে এসব দাবি করা হয়। সভায় বক্তারা বলেন, সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি সবার ভেতরে আলো জ্বেলেছেন। নৈতিকতা এবং সত্যের জায়গায় খুব স্পষ্ট ছিলেন তিনি। স্বৈরশাসকের পতন চাইতেন, কিন্তু দেখে যেতে পারেননি।
অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সহধর্মিনি ও নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরিন পারভিন হক, চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতালের ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেন, সিডিএ বোর্ড মেম্বার সাংবাদিক জাহিদুল করিম কচি। সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক শেখ মোজাফ্ফর আহমদ।
গণমানুষের বিরুদ্ধে সরকারের একটি পদক্ষেপও নেই : ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক বলেন, মৃত্যুর এক মাস আগে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি জোর দিয়ে আমাকে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা ড. ইউনূসকে এত গালাগালি করছে, চট্টগ্রামের অধিবাসীরা রাস্তায় নামতে পারছে না’। আমি বলেছি, ইউনূস তো শুধু চট্টগ্রামের না। দেড়শ–এর উপর নোবেল লরিয়েট বিবৃতি দিল, তাতেও কিছু হচ্ছে না; আমরা চট্টগ্রামের চা–পোষা মানুষ কিভাবে লড়াই করব। তখন তিনি (জাফরুল্লাহ চৌধুরী) বললেন, লড়াই করতে হবে, লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, ইউনূসকে রক্ষা করলে আমরা অনেক অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব। ড. ইউনূসের প্রতি জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অনেক আস্থা ছিল।
উপদেষ্টা বলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের কিছু ভুল–ত্রুটি হচ্ছে। কিন্তু ন্যায়সঙ্গতভাবে গণমানুষের বিরুদ্ধে আমাদের একটা পদক্ষেপও হচ্ছে না। আমরা প্রত্যেকটা পদক্ষেপ বিবেচনা করছি। ভাঙাচোরা একটা মন্ত্রণলায় যা আমরা পেয়েছি, সেটা দীর্ঘ ১৫ বছরের একটা কলুষিত মন্ত্রণালয়। এগুলোকে অ্যাক্টিভেট করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এরা শাসক না, এরা সেবক। এদের মজ্জ্বায় অস্থিতে শাসক, এরা শাসক হিসেবে জনগণকে শাসন করেছে। সে মানসিকতা দূর করতে আমাদের সময় লাগছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি।
ফারুক–ই–আজম বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে আপোষহীন ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। যত বড় শক্তিই হোক উনি সেটাকে বড় মনে করতেন না। যারা দেশের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বে শঙ্কা সৃষ্টি করতেন ঢাকার রাস্তায় হুইল চেয়ারে বসে তাদের সোচ্চার কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ করতেন। এটাই বাংলাদেশের তরুণদের কাছে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে অক্ষয়–অমর করে রাখবে।
উপদেষ্টা বলেন, আমাদের সরকার এখন যে কাজ করছে সর্বোতভাবে জাফর ভাইয়ের (জাফরুল্লাহ চৌধুরী) চিন্তা–চেতনার মধ্যে কাজ করছে। ড. ইউনূস এবং জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মধ্যে নিবিড় সখ্য ছিল। এটা ব্যক্তি সখ্য না, অন্তরের সখ্য ছিল। ড. ইউনূস. ডা. জাফরুল্লাহ এবং ফজলে হাসান আবেদ মিলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডায়ালসিস সেন্টার করেছেন। এটা তিনি গর্ব করে বলতেন। তিনি বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের হৃদয়ে বিচিত্র রেখা এঁকে গেছেন। তিনি ছিলেন আমাদের বটবৃক্ষ। চট্টগ্রামবাসী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্মরণসভায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিলেন। হল কানায় কানায় পূর্ণ থেকে তাঁর প্রতি সবাই যেভাবে শ্রদ্ধা জানালেন, এতে বলতেই হয় তিনি অমর।
রাজনীতিতে ভুল থাকায় চব্বিশ ঘটেছে : সমাজকল্যাণ ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। তাদের সুস্থ করতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের খালি হাতে খালি পায়ে গ্রামে ফিরে যেতে হয়েছিল। দেশটাও গত ৫০ বছরে গড়েই উঠল না। গণতন্ত্র, সাম্য, সমাজতন্ত্র, ন্যায়বিচার সবই আড়ালে থেকে গেল। আমাদের রাজনীতি নিশ্চয় ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সেই রাজনীতি ভুল ছিল বলেই চব্বিশ ঘটেছে।
তিনি বলেন, বাঙালি সরলভাবে সবকিছু সত্য বলে না, পেঁচিয়ে কথা বলে। কিন্তু অসাধারণ সরল সত্য বলতেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। নৈতিকতা এবং সত্যের জায়গায় খুব স্পষ্ট ছিলেন। দেশপ্রেমিক নিবেদিত মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। নানাভাবে আমাদের সবার মাঝে একধরনের আলো জ্বালিয়েছেন। সময়ের প্রবর্তনে প্রতিটি সংকট ও পরিবর্তনে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে স্বপ্রাণে কাছে পেয়েছি।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সংস্কৃতি বিরাজমান, সেটির পরিবর্তন ঘটেনি। তরুণদের এই শিক্ষাটা মাথায় রাখতে হবে। পেছনের পচে যাওয়া প্রথাগুলো গ্রহণ করে রাজনৈতিক দল গড়তে চাইলে ভুল হবে। আদর্শের জায়গায় দাঁড়াতে হবে। এ জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পথ অনুসরণ করতে হবে।
চালু হবে গরিবের হাসপাতাল : ডা. শাহাদাত বলেন, চট্টগ্রামে জাফরুল্লাহ চৌধুরী একটা গরিবের হাসপাতাল গড়েছেন। বর্তমানে স্বাস্থ্যের জন্য প্রচুর বাজেট আছে। সবাই মিলে আমরা সেই গরিবের হাসপাতাল চালু করবো। আমাদের মেমন–২ হাসপাতালকে জিরো ক্যাশ কাউন্টার হাসপাতাল করব।
তিনি বলেন, ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির সমাবেশ হয়। ওই সমাবেশে অসুস্থ শরীরে হুইল চেয়ার নিয়ে আসেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। অসুস্থতার মধ্যেও রিস্ক নিয়ে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি (জাফরুল্লাহ চৌধুরী) বলেছিলেন, ‘সরকার সবার টুঁটি চেপে ধরেছে, তার প্রতিবাদ করতে এসেছি। মানুষের ভোটাধিকারের কথা বলতে এসেছি’।
মেয়র বলেন, ইন্ডিয়ান হাই–কমিশনার আমাকে বলেছেন আপনাদের রোগী তো ভারতে চলে যাচ্ছে, এখানে ভালো ডাক্তার নেই নাকি? এই কথাগুলো শুনতে ভালো লাগে না। বাংলাদেশের ডাক্তাররা অনেক অভিজ্ঞ, তারা কোয়ালিফাইড। শুধুমাত্র ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর ওষুধের গুণগত কারণে ডাক্তারদের বদনাম হচ্ছে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী যদি দেশের স্বাস্থ্যনীতি বা ওষুধ ঠিক না করতেন তাহলে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর অবস্থা কী দাঁড়াত তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মেয়র বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মত এমন একজন মানুষকে আমরা হারিয়েছি যিনি সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক। যদি আমরা দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য এমন মানুষের প্রয়োজন ছিল।
অন্যান্য : জোনায়েদ সাকী বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে রাজনীতিতে হতাশা নেমে এসেছিল। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর আগের রাতে ভোট হয়ে গেল, তারপর বিএনপির মতো দল ছয়টি আসন নিয়ে সংসদে থাকতে হলো; এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় আকারের হতাশা নেমে এসেছিল। ২০১৯ সালে বড় আকারের কোনো রাজনৈতিক সংগ্রাম দানা বাধেনি। বিএনপিও তখন চিন্তা করছিল, কীভাবে সংগ্রামের পথ অনুসন্ধান করা যাবে। সে রকমই এক সময়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলেন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগপর্যন্ত তিনি আন্দোলনে ছিলেন।
শিরিন পারভিন হক বলেন, বাক স্বাধীনতাসহ সবগুলো মৌলিক অধিকারের পক্ষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি সবসময় দেশের পক্ষে ছিলেন। স্বৈরশাসকের পতন চাইতেন, কিন্তু দেখে যেতে পারেননি। জুলাই অভ্যুত্থান দেখলে কি যে খুশি হতেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, গ্যাস ও সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। গ্যাস ও তেলের বর্ধিত মূল্য বিবেচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারে প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের নাম জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নামে করার দাবি জানাচ্ছি।
ডা. রবিউল হোসেন বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিল সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। গরিবের ডাক্তার ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সে গণ মানুষের ডাক্তার ছিল।
জাহিদুল করিম কচি বলেন, প্রাণবন্ত ও নির্লোভ মানুষ ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৬ বছর ধরে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই সেখানে প্রেরণা ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাই ব্রিগেডিয়ার শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ওষুধ নীতি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। হাটহাজারীতে গরিবের জন্য গণ হাসপাতাল করতে চেয়েছিলেন। কয়েক কোটি টাকা খরচ করলেও কুচক্রী মহলের জন্য চালু করা সম্ভব হয়নি। দেশের ও জনস্বার্থে যে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেন, এতে তার পরিবারের কেউ এফেক্টেড হলেও ছাড় দিতেন না।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বোন অধ্যাপিকা আলেয়া চৌধুরী বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিন্তা ও কর্মকে ছড়িয়ে দিতে পারলেই স্মরণসভা স্বার্থক হবে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট ফাহিম শরীফ খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করেন নুরুন্নেছা মুন্নী। বক্তব্য রাখেন গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রামের সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমী, ভাসানী জনশক্তি পার্টি চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক সেলিম নূর, গণ অধিকার পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর সাধারণ সম্পাদক মো. ইউছুপ, গণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র চট্টগ্রামের কর্মকর্তা মং উচিং মারমা, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নেতা মো. জাবেদ আহমেদ, নাগরিক ঐক্য চট্টগ্রামের সমন্বয়ক নুরুল আবছার স্বপন, কলি কায়েস, মনজুরুল হাসান মাহীন, আবদুল্লাহ আল শাহেদ।