আশ্বিনের তৃতীয় সপ্তাহ। ১৪২৮ বংগাব্দ।
ব্যস্ত লাইফস্টাইল, ফাস্টফুডের অতি ব্যবহার, স্ট্রেস ও অনিয়ম এর ফলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী বর্তমানে ঘরে ঘরে বেড়েই চলেছে। ডায়াবেটিস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। কিন্তু এ নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারনা আমাদের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যেগুলো অনেক সময় প্রাণঘাতি হতে পারে।
ডায়াবেটিস সম্পর্কিত প্রচলিত ভ্রান্ত ধারনাসমূহঃ
ক. খাবার সম্পর্কেঃ
১. ডায়াবেটিস রোগীরা মিষ্টি খেতে পারবেন নাঃ
একজন ডায়াবেটিস রোগী অবশ্যই মিষ্টি খেতে পারবেন তবে তা হতে হবে (১) সীমিত ও পরিমিত পরিমানে, (২)জটিল শর্করা জাতীয় খাবার যেমন ভাত গ্রহণের পরে, (৩) তা যেন খাদ্য গ্রহনকারীর স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের একটি ক্ষুদ্র অংশ হয় যাতে প্রাপ্ত ক্যালরীটুকু তিনি শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে খরচ করে ফেলতে পারেন।
২. বেশী বেশী চিনি খেলে ডায়াবেটিস হয়: এটি একটি ভুল ধারনা। কারো মধ্যে টাইপ-১ ডায়াবেটিস তখনি দেখা যায় যখন তার দেহে সঠিক পরিমাণে ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না। ইনসুলিন বিভিন্ন কারণে কম উৎপন্ন হতে পারে-জন্মগত, লিভারের দীর্ঘকালীন কোন রোগ,অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি। অধিক সুগার বা অধিক ক্যালরীযুক্ত খাবার বেশী মাত্রায় গ্রহনের ফলে ওজন বেড়ে যায় বা স্থুলতা দেখা দেয় যার কারণে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে সব সময় অধিক চিনি খাওয়া ডায়াবেটিস হওয়ার কারণ নয়।
৩. ডায়াবেটিক রোগী রুটি খেতে পারবেন, ভাত নয়: আসলে ভাত আর রুটির মধ্যে ক্যালরীর পার্থক্য খুব বেশী নয়। তবে ভাতের তুলনায় বিশেষত: লাল আটার রুটি দেরীতে হজম হয় যার কারণে রুটিকেই আমরা প্রাধান্য দিই বেশী। তার মানে এই নয় যে ডায়াবেটিস রোগী ভাত খেতে পারবেন না। তাঁরা অবশ্যই ভাত খেতে পারবেন তবে পরিমিত পরিমানে। যেমন দুইটি মাঝারী আকারের রুটির পরিবর্তে আধা কাপ ভাত খাওয়া যেতে পারে।
৪. শর্করা এবং ফ্যাট জাতীয় খাবার সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে: আমাদের দেহের দৈনিক এবং স্বাভাবিক কার্যকলাপের জন্য কিছু ন্যূনতম পরিমানের শর্করা ও ফ্যাট প্রয়োজন। এটি একজন ডায়াবেটিস রোগীর জন্যও প্রযোজ্য। কিন্তু একজন ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে যেহেতু এই উপাদানগুলির অপরিকল্পিত গ্রহণ তার স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে সেহেতু এদের গ্রহণে কিছু দিক বিবেচনায় রাখতে হবে।
৫. দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা তেমন বড় কোনো বিষয় নয়: দীর্ঘ সময় অভূক্ত থাকার ফলে একজন ডায়াবেটিক রোগীর রক্তের গ্লুকোজ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক নিচে নেমে আসে। ইনসুলিন বা ওষুধ সেবনকারীদের জন্য এটি অনেক ভয়াবহ, কেননা এর ফলে একজন ডায়াবেটিক রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
৬. ফল ও শাকসবজী যে কোনো পরিমানে খাওয়া যেতে পারে: ধারনাটি সঠিক নয়। সব ধরনের খাদ্য উপাদান গ্রহণের নির্দিষ্ট সীমা রয়েছে। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাইট্রাস ফল অর্থাৎ ভিটামিন সি যুক্ত ফল যেমন লেবু মালটা, আংগুর, আমলকি, জাম্বুরা, পেয়ারা, কামরাংগা ইত্যাদি পর্যাপ্ত পরিমানে খেতে বলা হয়। তবে বেশী মিষ্টি ফল যেমন, আম, কলা এগুলো এড়িয়ে চলা বা কম পরিমানে গ্রহণ করা ভাল। আবার কিছু সবজী যেমন: লালশাক, পালং শাক, কলমি শাক, গিমা শাক, লাউ, বরবটি, পেপে, কাঁচকলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পটল চিচিংগা, ধন্দুল, ঢেঁড়শ, শসা ইত্যাদিও একজন ডায়াবেটিক রোগী তার খাবারে রাখতে পারেন। তবে মূল ও কন্দ জাতীয় শব্জী যেমন আলু, কচুর মূল, গাজর, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি কম পরিমানে গ্রহণ করাই ভালো।
৭. ডায়াবেটিক ডায়েট বিশেষ ধরনের ডায়েট: এই কথাটি সত্য নয়।এটি একটি সাধারণ ডায়েট প্ল্যান বা খুবই সাধারণ খাবার তালিকা যাতে কিছু উল্লেখযোগ্য খাবারকে রোগ নিয়ন্ত্রণে বিবেচনায় রেখে কম বা বেশী পরিমানে গ্রহণ করা হয়। যেমন শর্করা কম, আঁশ জাতীয় বেশী। ডায়াবেটিস অবশ্যই নিরাময়যোগ্য নয়। কিন্তু কিছু কিছু খাদ্যাভ্যাস একজন ডায়াবেটিক রোগীকে সুস্থ রাখতে পারে।
খ. ডায়াবেটিস রোগ সম্পর্কিত:
১.ডায়াবোটস একটি ছোঁয়াছে রোগ: এটি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায় না। ডায়াবেটিস মূলত: জেনেটিক বা পরিবেশগত উপাদানের উপর নির্ভর করে।
২. ইনসুলিন হলো ডায়াবেটিস রোগের সর্বশেষ চিকিৎসা: অনেকে মনে করেন ইনসুলিন একবার ব্যর্থ হলে রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব নয়। এটি ভুল ধারনা। এমন অনেক রোগী আছেন যারা আগে ইনসুলিন নিতেন, এখন ইনসুলিনের প্রয়োজন হচ্ছে না। তাদের জন্য মুখে খাওয়ার ওষুধই যথেষ্ট। আসল কথা হচ্ছে ইনসুলিন কখনও ব্যর্থ হয় না।
গ. ডায়াবেটিস চিকিৎসা সম্পর্কিত:
১. অনেকেই মনে করেন, চিকিৎসক ইনসুলিন নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মানে রোগী মোটেও নিয়ম মেনে চলছেন না। বাস্তবে এ ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার পরেও একটা সময়ের পর ইনসুলিন নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায়, যে কোনো বড় অস্ত্রোপচারের আগে-পরে, কিডনী বা যকৃতের জটিলতা ইত্যাদিতে ইনসুলিনই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ চিকিৎসা।
২. অনেকের ধারণা ডায়াবেটিসের ওষুধ বেশীদিন খেলে সেটি শরীরের নানা ধরনের ক্ষতি করে: এরূপ ভুল ধারনা বশত: অনেকেই মাঝে মাঝে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন। অনেকে আবার বিভিন্ন গাছের পাতা, শেকড়-বাকড় খেয়ে থাকেন। আসলে ওষুধে তো গাছপালার রসায়নই ব্যবহার করা হয় এবং এটি হিসাব করে বৈজ্ঞানিকভাবে যতটুকু দরকার ততটুকু যুক্ত করা হয়। কিন্তু সরাসরি গাছের পাতা, শেকড় বাকড় খেলে তো ক্ষতির সম্ভাবনা বেশী। গাছের পাতার রাসায়নিক গঠন একেক জায়গায় একেক রকম। পাতা কচি হলে একরকম, বয়ষ্ক হলে আরেক রকম।এতে সুগার লেভেল অস্বভাবিকভাবে উঠানামা করে
ঘ. প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত: কম বয়সী মেয়েদের ডায়াবেটিস ধরা পড়লে আর কখনও সন্তান হবে না: এই ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত হবার কারণে ডায়াবেটিক মেয়েদের আর বিয়ে হয় না। ’আপনারা ইউটিউবে শিলা ধরের ভিডিও দেখতে পারেন। এক বছর বয়সে তার ডায়াবেটিস ধরা পড়ে এবং এ ঘটনার কিছুদিন আগেই ইনসুলিন আবিষ্কার হয়েছে। শিলা ধরের মা তখন থেকেই তাকে ইনসুলিন দেয়া শুরু করেন। ২০১২ সালে ৮১ বছর বয়সে শিলা ধর সাক্ষাতকার দেন এবং বলেছেন-তিনি বিয়ে করেছেন, বাঁচাও আছে। তিনি কখনই তার ডায়াবেটিসকে অনিয়ন্ত্রিত হতে দেননি (গোনিউজ ২৪ ডট কম. ১৬-০৯-২১)’। ঙ. রক্তদান সম্পর্কিত: ডায়াবেটিস আক্রান্তরা কখনও রক্তদান করতে পারবেন না: এ ধারনা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কারণ যারা নিয়মিত ইনসুলিন ইনজেকশন নেন, তারাই শুধু রক্ত দান করতে পারেন না। বাকিদের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে, কোনো সমস্যা নেই। চ. যৌনজীবন সম্পর্কিত: ডায়াবেটিস মানে সেক্সুয়েল লাইফ শেষ: ডায়াবেটিসের কারণে সেক্সুয়েল অংগগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এটি মানসিক সমস্যা হিসাবে দেখা দেয়।
ছ. বয়স ভেদে: শুধু প্রাপ্তবয়ষ্কদেরই টাইপ ২ ডায়াবেটিস হতে পারে: এই ধারণাটি ভুল। বর্তমানে প্রায় সব বয়সের মানুষের মধ্যে টাইপ-২ ধরনের ডায়াবেটিস হতে দেখা যায়। জ. ব্যায়াম সম্পর্কিত: ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের সব সময় উচিৎ খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণে রেখে যতটা সম্ভব কম পরিশ্রম করা: এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ নিয়ম মেনে চললে আর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডায়াবেটিকরাও বাকিদের মতোই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন।
উপসংহার: ডায়াবেটিস এক ধরনের বিপাকীয় বিশৃংখলাজনিত দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি। এটি যদিও নিরাময়যোগ্য নয়, তথাপি এটি নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়। তাই ডায়াবেটিস সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণাসমূহ মন থেকে ঝেড়ে ফেলে সঠিক তথ্য সমূহ জেনে নিয়ে সুস্থ জীবন যাপন করুন।
লেখক : ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক