জুম’আর খুতবা

হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কদর

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৫ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র কুরআনের আলোকে লাইলাতুল কদরের ফযীলত: লাইলাতুল কদর এমন এক ফযীলতপূর্ণ মহিমান্বিত রজনী যে রাতের গুরুত্বকে কেন্দ্র করে পবিত্র কুরআনে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল হয়েছে, পাঁচ আয়াতের এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে “আল ক্বদর”। সূরা কদরে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআনকে) লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি। আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হচ্ছে এক হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতের যাবতীয় কাজের জন্য ফেরেস্তাগন ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে এটা নিরাপত্তা যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা: আল কদর, আয়াত: )

কদর এর অর্থ ও তাৎপর্য: উপমহাদেশে এই পুণ্যময় রজনীটি শবে কদর নামে পরিচিত। শব শব্দটি ফার্সী এর অর্থ হল রাত, আরবিতে লাইলাতুন অর্থ রজনী। কদর শব্দের অর্থ বর্ণনায় তাফসীরকারদের বিভিন্ন মত পাওয়া যায় ‘কদর এর এক অর্থ সম্মান’ মূল্য বা গুরুত্ব। কদরের রাতের গুরুত্ব, সম্মান ও তাৎপর্য অবর্ণনীয় বলে এর নাম হয়েছে কদর। কদর এর এক অর্থ তাকদীর বা ভাগ্যলিপি, এ রজনীতে বান্দার ভাগ্য লিপি ফেরেস্তাদের নিকট উপস্থাপন করা হয়। মূলত তাকদীর তো চুড়ান্ত বিষয় যা আসমান ও জমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগেই লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। কদরের রাতে এক বছরের সামগ্রিক বিষয় ফেরেস্তাদের হাতে ন্যস্ত করা হয়। কদর এর এক অর্থ সংকীর্ণ হওয়া, এ রজনীতে জমীনে এতো অধিক সংখ্যক ফেরেস্তা অবতরণ করেন যে পৃথিবী সংকীর্ণ হয়ে যায়, পৃথিবীর কোথাও সংকুলান হওয়ার মতো স্থান থাকে না। বোখারী শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা গ্রন্থ “উমদাতুল কারী” কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, যাবতীয় বিষয়াদির ফায়সালা আদেশ নির্দেশ ও মর্যাদা নিরূপনসহ এ রাতে আল্লাহ তা’আলা এক বছরের সামগ্রিক বিষয়ে ফায়সালা চুড়ান্ত করেন। (উমদাতুল কারী শরহে বুখারী, : ১১, পৃ: ১২৮)

এ এক বছরে কারা মৃত্যু বরণ করবে, কারা ধনী হবে, দরিদ্র হবে, রিযিক কোথায় কিভাবে কি পরিমাণ হবে সব বিষয়ে পরিচালনার দায়িত্ব ভার ফেরেস্তাদের হাতে এ রাতে অর্পন করা হয়। বান্দার দায়িত্ব হলো এ রাতে কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা। ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকা।

ক্ষমা প্রার্থনার রাত লাইলাতুল কদর: কদরের রাত ইবাদতের রাত। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের রাত, সম্মান ও মর্যাদা হাসিলের রাত। অধিক পরিমাণ নফল ইবাদতের রাত। এ মহান রাতের মহত্ত গুরুত্ব হাসিলের জন্য ফেরেস্তারা পর্যন্ত আসমানের বাইতুল মামুর ছেড়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন, যে সব বান্দারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্ত আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্তির আশায় এ রাতের সুবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া করবেনা তারা বড়ই সৌভাগ্যবান। হাদীস শরীফে এ রাতের ফযীলত সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে কাদরের রাত জেগে ইবাদত করবে তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ (সগীরা গুনাহ) ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহীহ আল বুখারী, হাদীস: ১৯০১)

শবে কদরের কল্যাণ থেকে যে বঞ্চিত সে সমগ্র কল্যাণ থেকে বঞ্চিত: রমজানের শেষ দশকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিবারের প্রত্যেককেই জাগ্রত থেকে ইবাদত করার জন্য প্রস্তুত করতেন। নবীজির ইতিকাফ পালন ও কোমর বেধে ইবাদত করার অন্যতম কারণ হলো লাইলাতুল কদর অর্জন করা। এ রাতের নফল ইবাদত যিকির আযকার তাসবীহ তাহলীল তাওবা এস্তেগফার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের উপর অধিক পরিমান দরুদ শরীফ পাঠ করা ইত্যাদি বরকতময় আমলের মাধ্যমে কল্যাণ ও সওয়াব অর্জনে সচেষ্ট হওয়া প্রত্যেক মু’মিনের দায়িত্ব। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় এ মাসটি তোমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছে এতে এমন এক রাত রয়েছে যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হল যেন যাবতীয় কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো, আর একেবারে হতভাগ্য ছাড়া কাউকেই এ রাত থেকে বঞ্চিত রাখা হয় না। (সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস: ১৬৪৪)

রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রজনীতে লাইলাতুল কদর: ফযীলত পূর্ণ রাতের ইবাদত যেন কেবল এক রাতেই কোনো বান্দা সীমাবদ্ধ না রাখে, আল্লাহর দয়া অনুগ্রহ রহমত বরকত মাগফিরাত ও নিয়ামত লাভের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা উৎসাহ উদ্দীপনা ও আগ্রহ বান্দার অন্তরে যেন রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি বিজোড় রাত্রিতে জাগ্রত থাকে বান্দার অন্তরে ইবাদতের চেতনা ও প্রেরণা ও তাকওয়া অর্জনের মানসিকতা যেন সর্বদা অটুট থাকে এ হিকমতের কারণে শবে কদরকে অনির্দ্দিষ্ট রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র ২৭ রমজান কদরের একরাতের ইবাদতের উপর নির্ভর করে ইবাদত থেকে বিমূখ হয়ে পড়া এটা কুরআন সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ কারণেই উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশ দিনের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর। (বুখারী, হাদীস: ২০১৭)

২৭ রমজান কদর রজনী সম্পর্কে ইমাম আজম (.)’র গবেষণা: প্রখ্যাত সাহাবী হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, লাইলাতুল কদর ২৭ রমজানের রাত। হযরত ইমাম আজম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি পবিত্র কুরআনের সূরা কদরে বর্ণিত, “লাইলাতুল কদর” শব্দটি বিশ্লেষণ ও ইজতিহাদ করে ২৭ রমজানের রাতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর গবেষণায় “লাইলাতুল কদর” শব্দটিতে আরবি বর্ণমালার নয়টি অক্ষর ব্যবহৃত হয়েছে। সূরা কদরে লাইলাতুল কদর শব্দটি তিনবার উল্লেখ হয়েছে। সুতরাং ৩ সংখ্যাটি ৯ দিয়ে গুণ করলে ২৭ হয়, যা ২৭ রমজান লাইলাতুল কদর হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। হয়তো মুসলিম উম্মাহর অন্তরের মানাভাব আল্লাহ তা’আলা তাঁর কুদরতী রহস্যের নিরিখে উক্ত বরকতময় তারিখের মধ্যে নিহিত রেখেছেন।

লাইলাতুল কদরের দুআ ও আমল: লাইলাতুল কদর রজনীতে বান্দা আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য মসনুন দুআ সমূহ পাঠ করবেন, জীবনে অন্যায় পাপাচার ও অপরাধ কর্ম থেকে ক্ষমা প্রার্থনার দুআ সমূহ পাঠ করবেন। কুরআন তিলাওয়াত ও যিকর থেকে শুরু করে সব ধরনের ইবাদত ইসলামে স্বীকৃত ও অনুমোদিত। তবে অন্যান্য দুআ ছাড়াও একটা বিশেষ দুআ কদরের রাতে অধিক পরিমান পড়তে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়ে গেছেন, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ কে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি যদি কদরের রাত পেয়ে যাই কোন দুআটি পাঠ করব। নবীজি এরশাদ করেন, তুমি এ দুআটি পাঠ করবে “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি”। অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি পরম ক্ষমাশীল এবং ক্ষমা করতে ভালোবাসেন, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন। (তিরমিযী, হাদীস: ৩৫১৩)

শবে কদরের নফল ইবাদত: কদর রজনীতে নফল ইবাদতের ফযীলত সম্পর্কে আউলিয়ায়ে কেরাম বুজুর্গানেদ্বীন ও হক্কানী ওলামাদের বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। এ রজনীতে চার রাকাত, আট রাকাত, বার রাকাত, অনেকে বিশ রাকাত নামায পড়েছেন মর্মে প্রমান পাওয়া যায় “প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা তাকাসূর একবার এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস তিনবার পাঠ করবে, এক বর্ণনায় দু রাকাতের নিয়ত করে ৬ নিয়তে বার রাকাত আদায় করাও ফযীলত পূর্ণ। প্রথম রাকাতে সূরা কদর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস তিনবার পড়বে। প্রতি চার রাকাত অন্তর একশতবার দরুদ শরীফ পাঠ করবে, হযরত ইসমাইল হক্কী রাহমাতুল্লাহি আলাইহ বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি শবে কদরে ইখলাসের সাথে নফল নামায আদায় করবে তার বিগত জীবনের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:৩য়, পৃ: ৯৬, নুযহাতুল মাজালিস, খন্ড:, পৃ: ১২৯, তাফসীরে রহুল বয়ান)

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে মহিমান্বিত ফযিলত পূর্ণ রজনী লাইলাতুল কদরে পুণ্যময় আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

আবদুল জব্বার চৌধুরী

ফতেয়াবাদ, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: কোন ব্যক্তি অসুস্থতার কারণে রোযা রাখতে অক্ষম হলে তার শরয়ী বিধান সম্পর্কে জানালে কৃতার্থ হব।

উত্তর: যে ব্যক্তি অসুস্থতার কারণে রোযা রাখতে অক্ষম সে ব্যক্তি প্রতিটি রোযার পরিবর্তে ফিদইয়া দিয়ে দিবে। ফিদইয়া হলো প্রত্যেকটি রোযার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে দুবেলা খাবার দেবে অথবা প্রতিবেলার জন্য একটি ফিতরা পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য বা তার মূল্য প্রদান করবে। তবে ফিদইয়া আদায়ের পর যদি সুস্থ হয়ে যায় এবং রোযা রাখতে সক্ষম হয় তখন ফিদইয়া বাতিল হয়ে যাবে এবং ছুটে যাওয়া রোযাগুলোর কাযা আদায় করতে হবে। (বাহরুর রায়েক, খন্ড:, পৃ: ২৮১, রদ্দুল মুখতার, খণ্ড:, পৃ: ৪২৭)

অসুস্থ ব্যক্তি রোযা রাখতে অক্ষম বা রোযা রাখলে রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা হলে ফিদইয়া আদায় করবে। তিনি সুস্থ হওয়ার পর রমজানের রোযা কাযা করবে। (বাহারে শরীয়ত)

হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি ওযর ও অসুস্থতা ছাড়া রমজানের একটি রোযা ছেড়ে দিল সারা জীবন রোযা রাখলেও ঔই একটি রোযার ক্ষতিপূরণ হবেনা। (তিরমিযী, হাদীস: ৭২৩)

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্লাহর কুরআন মানব মনে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী মহাশক্তি
পরবর্তী নিবন্ধবিভিন্ন স্থানে ইফতার মাহফিল ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ