জানতাম না এত বড় দায়িত্ব নিতে হবে : শেখ হাসিনা

ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ দেশকে এগিয়ে নেবে

আজাদী ডেস্ক | শনিবার , ১৮ মে, ২০২৪ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

চার দশকেরও বেশি সময় আগে দেশে ফেরা হয়েছিল বলেই বঙ্গবন্ধু যে আশাআকাঙ্ক্ষা নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তবে দেশে এসে দলের কাণ্ডারির দায়িত্ব নিতে হবে, সেটি তার ভাবনায় ছিল না বলেও জানান তিনি। গতকাল শুক্রবার গণভবনে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে বক্তব্যে এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণকে সুন্দর ও উন্নত জীবন দিতে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে তাঁর দল দেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, প্রতিবার নির্বাচনের সময় চক্রান্ত হয়, সেটা মোকাবেলা করে আমরা বেরিয়ে আসি। আমাদের তা ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে যে অধিকারগুলো আদায় করেছিল, সেটা আমরা সমুন্নত করতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। খবর বিডিনিউজ ও বাসসের।

তিনি বলেন, আজকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেই, কিন্তু অন্তত এইটুকু বলতে পারি, তার বাংলাদেশ কিছুটা হলেও তিনি যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন এবং যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, কিছুটা হলেও সেটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের আগে বিদেশ চলে যাওয়ার ঘটনাও উঠে আসে তার কথায়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশা করেছিলাম আমরা খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। কিন্তু সেই ফিরে আসা আর হয়নি। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি জানতাম না যে আমাকে এত বড় একটা দায়িত্ব দেওয়া হবে। আমি কখনো এটা ভাবতে পারিনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনাসদস্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঢুকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করে। তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তখন জার্মানিতে। পরের ছয়টি বছর তাদের ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে মাতৃভূমিতে ফেরেন শেখ হাসিনা; হাল ধরেন আওয়ামী লীগের।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি তখন নেতাকে হারিয়ে এলোমেলো; সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে অনেকে কারাগারে, অনেকে পলাতক। সেই দলের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার বক্তব্যে উঠে আসে নির্বাসিত জীবনের পারিবারিক সংকটযন্ত্রণার কথা। তিনি বলেন, ছোট বোন শেখ রেহানার বিয়েতে থাকতে পারিনি। কিন্তু যখন তার বাচ্চা হবে, মিসেস গান্ধী (ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী) আবার ক্ষমতায় এলেন, তিনি সব ব্যবস্থা করে দিলেন, আমি গেলাম। এরপর আবার দিল্লিতে ফেরত আসলাম। তখন আমাকে লন্ডন থেকে আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুবুর রহমান টেলিফোন করে বললেন, আপনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছে। আমি তাকে বললাম, আমি তো আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে চাই না, আমাকে কেন করবে? আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আছে।

১৯৮১ সালের ১৭ মে’র ঘটনা বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেদিন সাধারণ মানুষ সেখানে গিয়েছিল। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বক্তব্য রাখলাম। সব থেকে বড় কথা হলো আমি যখন জার্মানিতে যাই, তখন কামাল, জামাল, রোজি, খুকি সবাই বিমানবন্দরে ছিল। আমি যখন ফিরে আসলাম হাজার হাজার মানুষ, কিন্তু আমি পেলাম বনানীতে সারি সারি কবর। ৩২ নম্বরে আমরা মিলাদ পড়তে চাইলাম, আমাকে ঢুকতে দেয়নি জিয়াউর রহমান। উল্টো বলেছিল বাড়ি দেবে, গাড়ি দেবে, সব দেবে। বলেছিলাম তার কাছ থেকে কিছু নেব না। খুনির কাছ থেকে আমি কিছু নিতে পারি না। আমি যখন দিল্লিতে ছিলাম, সেখানে গিয়ে জিয়াউর রহমান আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল, তার স্ত্রীও দেখা করতে চেয়েছিল, আমি দেখা করি নাই। লন্ডনে যখন তখনও দেখা করতে চেয়েছিল, আমরা দেখা করিনি। আমি যখন আসলাম ৩২ নম্বরে ঢুকতে দেবে না, উল্টো বাড়িগাড়ি সাদবে, সেটা তো আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না।

দেশে ফিরে কোথায় উঠবেন বা থাকবেন সেটা জানা ছিল না শেখ হাসিনার। সেই অনিশ্চয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, শুধু আমার পরার কাপড়চোপড়, দুটো স্যুটকেস ও পুতুলকে (মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল) নিয়ে আমি চলে এসেছি। তারপর এ যাত্রা শুরু। আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী ও দলকে গোছানোর চেষ্টা করেছি।

কথা বলতে বলতে আপ্লুত হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলব, আমার সব শক্তিসাহস মাবাবার কাছ থেকে পেয়েছি। উনি তো কোনোদিন বিশ্বাস করেননি বাঙালি তাকে হত্যা করতে পারবে। এই ঘাতকের দল মনে করেছিল একটি পরিবারকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করবে। শুধু পরিবার না, আমাদের যারা আত্মীয়স্বজন আছে তাদেরকেও।

৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। যারা স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, সংগ্রাম করলেন সারাটা জীবন, সেই বাংলার মাটিতে, বাঙালির হাতেই তাদের মৃত্যুবরণ করতে হলো। তাও স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা, যুদ্ধাপরাধীরা ক্ষমতায়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের কথা বর্ণনা করে তিনি বলেন, আমার তো বিচার চাইবার অধিকার ছিল না। মামলা করতে গিয়েছি, মামলা নেবে না, করা যাবে না। কারণ খুনিদের পুরস্কৃত করা হয়েছে, তাদের হিরো বানানো হয়েছিল।

১৯৭৫ পরবর্তী যুদ্ধাপরাধীরা মন্ত্রীএমপিউপদেষ্টা হয়েছিল বলে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ যারা করছেন তারই অপরাধী হয়ে গেল। যারা বিরোধিতা করেছিল, গণহত্যা করেছিল তারাই ক্ষমতায়। ওই অবস্থায় দেশে ফিরেছিলাম। আমার তো কিছুই ছিল না। একটা বিশ্বাস ছিল দেশের জনগণ ও আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মী। এরপর লড়াইসংগ্রাম করে এইটুকু বলতে পারি পঞ্চমবারের মতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতা এসেছে।

সংগঠনকে শক্তিশালী করার তাগিদ : আজকের বাংলাদেশ ‘বদলে যাওয়া বাংলাদেশ’ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের যদি রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা না থাকে, দেশপ্রেম না থাকে, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় না থাকে, তাহলে সেটা এগুতো পারে না।

আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত থাকায় করোনাভাইরাসহ সব দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দলের প্রত্যেকটা সংগঠন জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সমানতালে কাজ করেছে বলেই আমরা এ সাফল্যটা দেখাতে পেরেছি। তাছাড়া কোনোভাবে সম্ভব ছিল না। আওয়ামী লীগ সংগঠন ছাড়া দেশের জনগণের জন্য আত্মত্যাগ অন্য কেউ করে না।

আওয়ামী লীগের সংগ্রামের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা, কারফিউ, প্রতিরাতে মার্শাল ল, দেশের মানুষের কোনো আশা নেই, শুধু হতাশা। এই হতাশ জাতিকে টেনে তোলা যায় না। তাদের মাঝে আশার আলো জাগাতে হয়, ভবিষ্যত দেখাতে হয়, উন্নত জীবনের চিত্র তুলে ধরতে হয়। তবেই মানুষকে নিয়ে কাজ করা যায়। আমরা সেটাই করার চেষ্টা করছি। সেদিন ফিরে এসেছিলাম, এত বড় দল পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা ছিল না, যখন ছাত্রলীগ করার সময় নেতা হওয়ার চেষ্টা করি নাই। দলের প্রয়োজনে যে দায়িত্ব দিয়েছে সেটাই পালন করেছি। কিন্তু যখন এ দায়িত্ব (আওয়ামী লীগ সভাপতি) পেলাম, এটা বড় দায়িত্ব। আজকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে শক্তিশালী বড় সংগঠন। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য দল আওয়ামী লীগ। প্রতিবার চক্রান্ত হয়, সেটা মোকাবিলা করে আমরা বেরিয়ে আসি। আমাদের তা ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে যে অধিকারগুলো আদায় করেছিল, সেটা আমরা সমুন্নত করতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

সংগঠনকে শক্তিশালী করার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আর যেন যুদ্ধাপরাধী, খুনিরা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে, এই ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপতেঙ্গা প্রান্ত নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের যত চিন্তা
পরবর্তী নিবন্ধনগরের প্রথম আন্ডারপাস হচ্ছে বহদ্দারহাটে