জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১৭ মার্চ, ২০২১ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

জন্মনিবন্ধন সনদপত্র নিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন লাখো মানুষ। দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়েও জুটছে না স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জন্মনিবন্ধন সনদপত্র। একটি সনদপত্রের জন্য কয়েক দফা যেতে হচ্ছে কাউন্সিলর অফিসে। ম্যানুয়াল জন্ম সনদ আপডেট না করা এবং সার্ভার সমস্যার কারণে মানুষের ভোগান্তি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
সূত্র জানায়, সরকার ২০১০ সাল থেকে অনলাইনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করেছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে এই সনদপত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অনলাইনে নিবন্ধন শুরু করার আগে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে কয়েক কোটি নাগরিককে জন্ম নিবন্ধন সনদ দেয়া হয়েছে। অনলাইন হওয়ার পর আগে দেয়া ম্যানুয়েল পদ্ধতির সনদগুলো আপডেট করা হয়নি। ফলে দেশে কয়েক কোটি নাগরিককে নতুন করে সনদপত্র নিতে হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠেছে সার্ভার। গত কয়েক মাস ধরে সার্ভার ত্রুটির কারণে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম মূলত মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অপরদিকে জন্ম নিবন্ধন সনদপত্রের ক্ষেত্রে নয়া এক নিয়ম নতুন সংকটের সৃষ্টি করেছে। ২০০১ সালের পর যাদের জন্ম তাদের জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের জন্ম সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে অনেকেরই অবস্থা নাজুক হয়ে উঠেছে। এসব ক্ষেত্রে প্রথমে বাবা মায়ের জন্ম নিবন্ধন করিয়ে তারপর সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে হচ্ছে। অর্থাৎ একজনের জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে তিনজনের জন্মনিবন্ধন করতে হচ্ছে। ফলে প্রতিটি নিবন্ধনকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ রকমের ভোগান্তি তৈরি হয়েছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে নতুন নিয়ম কার্যকর করায় এমনটি হয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক করা হয়েছে জন্মনিবন্ধন সনদ। এতে সন্তানের জন্মনিবন্ধন পেতে বহু পিতা মাতারই মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে। আবার সন্তানের জন্ম নিবন্ধনের সময় পিতা-মাতার জন্ম নিবন্ধন করানোর ক্ষেত্রে দাদা-দাদীর জন্মনিবন্ধন নম্বর চাচ্ছে। যেটি ছাড়া অনলাইন সার্ভারে ডাটা নিচ্ছে না। এছাড়া ইংরেজী সংখ্যা দেয়ার সাথে সাথে কথায় কিছু লেখা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসছে। যেগুলো ভুল।
প্রসঙ্গক্রমে, গতকাল একজন অভিভাবক বলেছেন, চারদিন ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জন্মনিবন্ধন করাতে পেরেছি। আমার সন্তানের জন্ম তারিখ ২৩ মার্চ। ইংরেজীতে ২৩ এর পরে ‘আরডি’ হওয়ার কথা, অথচ স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসছে ‘টিএইচ’। কি আর করা! ভুল করা সনদপত্র নিয়ে কোনো রকম কাজ সারতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, জন্মসনদ বাংলা এবং ইংরেজী ভাষায় করা হয়। এটিও একটি সংকট তৈরি করেছে। কোনো সন্তানের বাবার সনদ ইংরেজীতে এবং মায়ের সনদ বাংলায় করা হলে তা দিয়ে সন্তানের রেজিস্ট্রেশন করানো সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে দুজনের একজনের সনদ পাল্টে নিতে হচ্ছে। সার্ভার সমস্যা একটি ভয়াবহ সমস্যা বলে উল্লেখ করে সূত্র জানান, ঘণ্টার পর ঘন্টা চেষ্টা করেও সার্ভারে ডাটা প্রবেশ করানো সম্ভব হচ্ছে না। এর উপর শত শত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। পাসপোর্ট করা, বিবাহ নিবন্ধন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, জমি রেজিস্ট্রেশনসহ প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করায় বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে মানুষের উপর মানুষ হুমড়ি খাচ্ছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে উঠছে।
গত তিনদিন ধরে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড কার্যালয়ে ঘুরে শত শত মানুষকে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। মোহাম্মদ ইমরান সালেহ নামের একজন ব্যবসায়ী জানান, তিনি চারদিন ধরে চেষ্টা করছেন। কিন্তু সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে পারেননি। মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম নামের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে জন্মনিবন্ধনের সক্ষমতা আজো আমাদের তৈরি হয়নি। একটি বিষয় গড়ে তোলার আগেই জনগণকে যুদ্ধে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন এখানে মানুষের মাথা মানুষ খাচ্ছে!
একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর বলেন, কী যে এক অবস্থা। আর কোনো কাজই করতে পারছি না। ম্যানুয়েলি আমরা শত শত মানুষকে জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়েছি। মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যেই মানুষকে সার্ভিস দিতে পেরেছি। এখন অনলাইনে করতে গিয়ে ভয়াবহ এক অবস্থা তৈরি হয়েছে। কবে যে এসব ঠিকঠাক হবে কে জানে?
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জন্মসনদে নতুন কিছু নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পুরো বিষয়টিকে একটি শৃংখলার মধ্যে আনার জন্য নতুন নিয়ম করা হয়েছে। বছরের শুরুতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যাপারটি থাকায় কিছুটা বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে। ক্রমে এই চাপ সহনীয় হয়ে যাবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এদিকে নতুন নিয়মে শূন্য থেকে ৪৫ দিন বয়সী শিশুর জন্ম নিবন্ধনের জন্য টিকার কার্ড, পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র, বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারী ট্যাঙের রশিদের হাল সনদ, আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর, ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি দি েহচ্ছে। ৪৬ দিন থেকে ৫ বছর বয়সীদের জন্ম নিবন্ধন নিতে টিকার কার্ড/স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যয়নপত্র (স্বাক্ষর ও সিলসহ প্যাডে হতে হবে), পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের প্রত্যয়নপত্র, বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারী ট্যাঙের রশিদের হাল সনদ, আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর, ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি, বয়স ৫ বছরের বেশি হলে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র (পিএসসি/জেএসসি/এসএসসি) শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র না থাকলে সরকারি হাসপাতালের এমবিবিএস ডাক্তারের স্বাক্ষর ও সিলসহ প্রত্যয়ন সনদ এবং জন্ম নিবন্ধন আবেদন ফরমের ৭ এর ১ নং কলামের স্বাক্ষর ও সিল বাধ্যতামূলক। যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর তাদের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক, যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির আগে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক, যদি জন্ম ২০০১ সালের আগে হয় সেক্ষেত্রে পিতা-মাতা মৃত হলে মৃত্যু সনদ বাধ্যতামূলক যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর তাদের পিতা-মাতা মৃত হলে প্রথমে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন গ্রহণ করার পর অনলাইন মৃত্যু নিবন্ধন সনদ গ্রহণ করতে হবে। উভয় সনদ আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে। বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারী ট্যাঙের রশিদের হাল সনদ, আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর এবং ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি আবেদনের সঙ্গে কাগজপত্র সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য/নারী সদস্যদের স্বাক্ষরসহ সিল বাধ্যতামূলক।
এত সব কাগজপত্র যোগাড় করে সার্ভার সমস্যার কারনে দিনের পর দিন ঘুরতে ঘুরতে বহু মানুষেরই ভোগান্তি চরমে উঠেছে। অনেকেই ডিজিটাল পদ্ধতি সহজ না হওয়া পর্যন্ত ম্যানুয়েলি জন্মনিবন্ধন সনদপত্র দেয়ার অনুরোধ করেছেন। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে সনদপত্র প্রাপ্তি সহজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন কর্মকর্তা ভোগান্তির কথা স্বীকার করে বলেছেন, এই ভোগান্তি বেশিদিন থাকবে না। অনলাইনে সহজেই নিবন্ধন সম্পন্ন করা যাবে। জন্ম মৃত্যুর অনলাইন নিবন্ধন ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমওদুদ আহমদ আর নেই
পরবর্তী নিবন্ধচসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের পাঁচ কর্মকর্তাকে শো’কজ