চিকিৎসা শ্রমিকের পথচলা : উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকটের কারণ ও প্রতিকার

ডা. হাসান শহীদুল আলম | সোমবার , ৮ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ

ভাদ্রের তৃতীয় সপ্তাহ। ১৪২৮ বংগাব্দ। পূর্বে লিখেছিলাম উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকটের বিপর্যস্ত চিত্র নিয়ে। এবারের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে উপজেলা হাসপাতালসমূহে চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকটসৃষ্ট সমস্যাদি এবং এই সংকটের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে। চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকটসৃষ্ট সমস্যাদি:
[ক] চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে মানুষ দরিদ্র হচ্ছে:’বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বিপর্যস্ত হচ্ছে ১৫ শতাংশ মানুষ। দরিদ্র হচ্ছে প্রতি বছর ৬৪ লাখ মানুষ। গবেষণায় প্রমাণিত স্বাস্থ্যসেবার ৬০ শতাংশ মানুষ নিজে খরচ করে। বৈশ্বিক মানদণ্ডে যা ৩২ শতাংশের নীচে।সরকারি খাত থেকে আসে মাত্র ১৪ শতাংশ এবং ২৬ শতাংশ বেসরকারি খাত থেকে।[বনিক বার্তা,২৬-০৯-২০]’। [খ] সাধারণ রোগ জটিল রোগে পরিণত হচ্ছে:‘ব্যক্তির এই ব্যয়ের ৬১ শতাংশ যায় শুধু ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয়ে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ গরু ছাগল জমিজমা বিক্রি করে চিকিৎসা ব্যয় মেটাচ্ছে এবং চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রাখছে। সাধারণ রোগ জটিল রোগে পরিণত হচ্ছে। বাংলা ট্রিবিউন,৩০-০৯-২০]’।
চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকটের কারণসমূহঃ
ক] সরকারের ব্যর্থতা: ১] প্রাইমারী স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ কম দেয়া: ‘মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ২৫ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে প্রাইমারী স্বাস্থ্যসেবায় [সমকাল,০৮-০৫-২১]। ২] উন্নয়ন ব্যয়ে কম বরাদ্দ থাকা: ‘সরকারি ব্যয়ের ৬১ শতাংশ যায় পরিচালন বাবদ। উন্নয়নে ব্যয় কম [সমকাল,০৮-০৫-২১]। ৩] স্বাস্থ্যখাতে অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দ দেয়ায় অধিদপ্তর চাহিদা পূরন করতে পারছে না: দ্রুত সরবরাহ চেয়ে অধিদপ্তরে চাহিদা পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর এ চাহিদা পূরন করতে পারছে না অধিদপ্তর। [বণিক বার্তা,২৪-০৬-২১] ৪] মেডিকেল উচ্চশিক্ষায় পরিকল্পনাহীনতা: আগামী পাঁচ বা দশ বৎসরে কোনো কোনো বিষয়ে কতজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক লাগবে সে ব্যাপারে সরকারের কোন পরিকল্পনা না থাকাতে ক্রিটিকেল কেয়ার চিকিৎসা টীমে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব দেখা যায়। ধরা যাক একটি সার্জারী টীমে লোকবল ঠিক থাকলেও একটির ঘাটতিতে যেমন অ্যানেস্তটিস্ট পুরো টীম অকার্যকর হয়ে পড়লো। এ কারণেই উপজেলায় সার্জারী, গাইনী, নাককানগলা বিশেষজ্ঞের পদায়ন হওয়া সত্বেও অপারেশন হয়না। ‘দেশের অন্তত ৩২টি হাসপাতালে ৬৫টি যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে অচল ও অব্যবহৃত পড়ে আছে। এগুলোর মধ্যে আছে এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাফি, অ্যানেস্তেশিয়া যন্ত্রপাতি, ল্যাপারেসকোপি, ষ্টেরিলাইজরি, অটোক্লেভ, ডায়াথার্মি সহ অন্যান্য সরঞ্জাম [প্রথম আলো,২২-০৮-২১]’।
৫] উপজেলা হাসপাতালে মেডিকেল স্টোর না থাকা: জীবনরক্ষাকারী ওষুধ রাখা হয় বারান্দা ও সিঁড়ির নীচে। এতে ওষুধ নষ্ট ও মানহীন হয়ে পড়ে।
খ] স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভ্রান্তনীতি:
১] হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কী ভিত্তিতে কেনা হবে তা জাতীয়ভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত থাকার কথা। অথচ বাংলাদেশে ৫০ থেকে ২০০০ বেডের হাসপাতালে কী কী যন্ত্রপাতি থাকবে তা নির্ধারিত নেই।
২] আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অব্যবস্থাপনা: ‘হাসপাতালগুলোতে যথাযথ অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের জন্য অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ থাকে। তাও বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জাটলতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে বাৎসরিক পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয় না। ডিজি অফিস থেকে অনেক যন্ত্রপাতির মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয় যা বাজেটের সাথে সামঞ্জস্য থাকে না। যার ফলে অনেক যন্ত্রপাতি কেনা যায় না। আবার কিছু কিছু যন্ত্রপাতির চাহিদা না থাকলেও হাসপাতালের জন্য পাঠানো হয়। ৩] বরাদ্দ অব্যয়িত থাকা: ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের ৭৬ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। ২৪ শতাংশ অব্যয়িত থাকছে [সমকাল,০৮-০৫-২১]। ৪] মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের অতি স্বল্প নিয়োগ দেয়া: নিয়োগদান প্রয়োজনের মাত্র ১৮ শতাংশ। ফলে মূল্যবান চিকিৎসা সরঞ্জামাদি টেকনিশিয়ানের অভাবে অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হয়ে যায়।
৫] আমলাতান্ত্রিক অব্যবস্থপনার কারণে ওষুধের অপ্রাপ্যতা: হাসপাতালগুলোতে একদিকে যেমন ওষুধ সংকট থাকে অন্যদিকে কিছু ওষুধ কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় যেগুলোর চাহিদা হাসপাতালে নেই।
৬] ওষুধের অপ্রতুল সরবরাহ: মেডিকেল স্টোর না থাকায় মাত্র ১০-১৫ দিনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়।
৭] উপজেলা হাসপাতালে জ্বালানির বরাদ্দ না রাখায় জেনারেটর অচল থাকে। গ] স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি
১] চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকট সম্পর্কে চিঠি দেয়ার পরেও অধিদপ্তরের কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া: ‘অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে কর্মকতা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে রিপোর্ট প্রেরণ করেন। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ সমস্ত বিষয়ে কখনো কোন ব্যবস্থা নেন না। যে সব অভিযোগ আসে তা রাখা হয় ফাইল বন্দি করে। নিয়ম অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে আখের গোছানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তদবির বা উৎকোচ দিলে ফাইল ছাড়া হয় (ইত্তেফাক, ০৬-০-২১)’। দেখা যায় যন্ত্র সংশ্লিষ্ট টেকনিশিয়ানের নিয়োগ দেয়া হয়নি। তখন যন্ত্র অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হয়ে যায়। মেরামতের জন্য যথারীতি অধিদপ্তরে রিপোর্ট করা হলে সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে যন্ত্রটি স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। ২] চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি: যে সব যন্ত্রপাতি ক্রয়ে মোটা কমিশন প্রাপ্তি, ওভারপ্রাইসিং ইত্যাদি বিবিধ প্রকারের দুর্নীতির সুযোগ থাকে সে সব মূল্যবান যন্ত্রপাতি নিয়মবহির্ভূতভাবে ক্রয় করে উপজেলা হাসপাতালসমূহে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অথচ তারা দাপ্তরিকভাবেই জানে যে উপজেলা হাসপাতালে যন্ত্রসংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা নেই এবং টেকনিশিয়ানের পদায়ন হয়নি বিধায় যন্ত্রটি অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হয়ে যাবে’। সরকারি যে কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার আগে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। প্রথমত: সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের কোনো চাহিদা দেয়া হয়েছে কিনা। দ্বিতীয়ত হাসপাতালে যন্ত্রটি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা এবং আনুষাঙ্গিক সুবিধা [যেমন বিদ্যুৎ ক্ষমতা] রয়েছে কিনা। তৃতীয়ত: যন্ত্র চালানোর জন্য দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবল হাসপাতালের আছে কিনা [ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী, মহাসচিব, বিএমএ, প্রথম আলো,২৩-০৮-২১]’। ‘অভিযোগ আছে, ব্যবসায়ীরা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে যন্ত্র কিনে তা হাসপাতালে পৌঁছে দেয় হাসপাতালের চাহিদার বিষয় বিবেচনা না করে। [প্রথম আলো,২৩-০৮-২১]’।
চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকটের প্রতিকার সরকারের করণীয়: [ক] একটি স্বাস্থ্য জনশক্তিনীতি প্রণয়ন করাঃ বিশেষঞ্জ চিকিৎসক ও যন্ত্রবিদ টেকনিশিয়ান রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরী করতে হবে। [খ] স্বাস্থ্যখাতে অপ্রতুল বাজেট ও বাজেট ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা নিরসন করতে হবে। গ] স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দে ইউনিয়ন পর্যায়কে গুরুত্ব দিতে হবে। ঘ] বড় বড় হাসপাতাল তৈরী না করে আগে মেডিকেল যন্ত্রবিদ টেকনিশিয়ান সংকটের সমাধান করতে হবে, ছ] মেডিকেল যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন আমদানীতে কর কমাতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করণীয়: ক] স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে: দেখা যায়, নভেম্বর ডিসেম্বরেও মন্ত্রণালয়গুলোর বিপরীতে প্রথম ত্রৈমাসিকের টাকা ছাড় হয় না। খ] বিশেষঞ্জ চিকিৎসক, মেডিকেল যন্ত্রবিদ টেকনিশিয়ানদের দক্ষতা বৃদ্ধি করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গ] ক্রয় পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা: রাজধানী থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত চিকিৎসাকেন্দ্রের সব কেনাকাটার পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা, মানসম্মত জিনিষপত্রের কেনাকাটার নিশ্চয়তা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক জিনিষটি সঠিক সময়ে নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে ক্রয় পদ্ধতির পরিবর্তন প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ জাতীয় কমিটি থাকবে। ধাপে ধাপে উপজেলা পর্যন্ত এই কমিটি বিস্তৃত হতে পারে। যেখানে বিশেষজ্ঞ সহ বিভিন্ন পর্যায়ের জনসম্পৃক্ততা থাকবে।
উপসংহার: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির কারণেই উল্লিখিত সংকটসমূহ সৃষ্টি হচ্ছে। চিকিৎসকগণ এরূপ দুর্নীতির সাথে কোনো ভাবেই জড়িত না থাকলেও সংকটের ফলে সেবা কার্যক্রম বিঘ্নিত হলে দায়ভার নিতে হচ্ছে চিকিৎসকদেরকে করোনাকালে অবর্ণনীয় দুর্দশা, অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয় ও চিকিৎসা পেতে অসহায়ত্ব জনগণকে চিকিৎসকদের প্রতি আরও ক্ষুব্ধ ও বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে। বিশেষ করে এজন্য নবীন চিকিৎসকদের ভোগান্তি হয় সবচেয়ে বেশী। যেহেতু উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নবীন চিকিৎসকদের পদায়ন হয়ে থাকে।
লেখক : ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিশোর গ্যাংয়ের ব্যাপারে সজাগ হওয়া জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধএক স্বভাব বন্ধুকে স্মরণ