পর্ব ২
চা বাগানের টিলাময় ভূখণ্ডে দৌড়ানোর লোভ সামলানো দায়। সকালে দৌড়ানোর জন্য বেরোলাম শারাফাত ভাইয়ের বাংলো থেকে। অবশ্য এই বাংলোতে শারাফাত ভাই ছাড়াও আরেকজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার থাকেন। এমনিতে বাগানের শেষ মাথায় উনার বাংলো। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যাওয়ায় উনার অপেক্ষাকৃত উঁচু বাংলোতে থাকেন না এখন। এই বাংলো যে টিলার উপর অবস্থিত তা অপেক্ষাকৃত নিচু। আপাতত এখানেই আবাস উনার। সকালটা এত স্নিগ্ধ। পাখির কলধ্বনি কানে আসে শুধু। চা গাছকে ছায়াদানকারী অ্যালবিজিয়া জাতীয় উদ্ভিদের ফাঁকে ফাঁকে দিনের সূচনাকারী উদীয়মান নতুন সূর্যকে দেখলাম। চা বাগানের হাওয়ায় নতুন হিমের আমেজ, ঋতু বদল আসন্ন।এদিকে ১০ কিলোমিটার দৌড়েও বাগানের সীমানা পেরোনো সম্ভব হয়নি আমার আর সানির; এর কলেবর এত্ত বড়! ফাঁকে ফাঁকে দেখলাম পুরো বাগানজুড়ে কাঠবিড়ালির দৌরাত্ম্য। দৌড়ানোর সময়ই দৃষ্টিগোচর হলো গুল্মজাতীয় দাঁতরাঙা গাছ। এই ঝোঁপজাতীয় গাছের ফল খেলে দাঁত লাল হয়ে যায় বলেই এহেন নাম। অবশ্য ফুটকি নামেও চেনে অনেকে। যদিও চা শ্রমিকদের কাছে এর পরিচয় অন্য নামে। তারা চেনেন নিশি গাছ নামে। এই গাছের উপস্থিতির আলাদা মাজেজা আছে চা বাগানে। চা বাগানের কোনো জায়গায় এই গাছের উপস্থিতির দ্বারা প্ল্যান্টাররা বুঝতে পারেন ঐ ভূখণ্ড চায়ের চাষের উপযোগী। এছাড়াও বাগানের যেখানেই বট–পাকুড়–অশ্বত্থের দেখে মিলেছে, সেখানেই পুজোর নৈবেদ্যের দেখাও পেয়েছি। সব গাছেরই পাদদেশ লাল সালুতে মোড়ানো! শুধু মজিদ–গোত্রীয় কারো দেখা মেলেনি।
বাংলোতে ফেরত আসতেই চা নিয়ে এলেন বেয়ারা। চা গাছের মতোই ছোটোখাটো গড়নের লোকটি কানেও খাটো। প্রাতঃরাশ সারতেই সকালের কাজ সেরে ফিরলেন শারাফাত ভাই। আরেক দফা চা বাগানের চায়ে চুমুক দিয়ে গল্প করছিলাম দার্জিলিং এর মাকাইবাড়ি চায়ের। মাকাইবাড়ির চায়ের সুনাম বিশ্বজুড়ে। চা থেকে গল্প চলে গেল দার্জিলিং–এ। শারাফাত ভাই আর আমার মধ্যে একটা মিল আছে। দুজনই জীবনের কোনো এক পর্যায়ে দার্জিলিঙে চা বাগানে চাকরি করতে চাই। আরেকটা শর্ত অবশ্য আছে। ওই চা বাগান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর দৃশ্যমান হলেই আমরা আগ্রহী! একটা অলিখিত চুক্তি করলাম দু’জনে। দ’ুজনের মধ্যে কারো চাকরি হলে আমরা একে অপরকে নিয়ে যাব সেখানে। আমাদের অপর সঙ্গী সানির আগ্রহ অবশ্য অন্য। এই বাংলোকে ঘিরে কোনো রহস্য আছে কি না সেটা জানতেই শারাফাত ভাইকে খুঁচিয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত নতুন বাংলো বলে তেমন কোনো রহস্যঘন কাহিনি এই বাংলোকে ঘিরে নেই। তবে দিন দশেক আগেই বাংলো থেকে শ‘খানেক মিটার দূরে একটা ফাঁস দেওয়া লাশ পাওয়া গেছে। সবার ধারণা মেরে সম্ভবত গাছের সাথে ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে জল্পনাকল্পনায় বেশ কদিন সরগরম ছিল বাগান। শারাফাত ভাই এর মাঝে দেখালেন মশা খাওয়া চায়ের পাতা। চায়ের পাতার নাকি সবচেয়ে বড়ো শত্রু মশা আর এক ধরনের লাল পোকা। কচি চা পাতা অধিক রসের কারণে মশার খুব প্রিয়। ওই চা পাতার সবুজাভ জমিনে অসংখ্য সরু, ছোটো ছিদ্র। মশার শুঁড়ের তেলেসমাতি। মশা নিধন চা বাগানের নৈমিত্তিক কাজের একটি। কর্তৃপক্ষ এর জন্য নালা তৈরি করে, লম্বা ঘাস–আগাছা উপড়ায়। পুরো ব্যাপারটা তারা বেশ দক্ষতার সাথেই করে বলা যায়। অন্যদিকে, প্রচুর বাজেট আর লোকবল নিয়েও আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে এই কাজে। চা বাগানে ততক্ষণে রোজকার কাজের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বারান্দায় বসেই দেখছিলাম চা শ্রমিকরা তাদের নির্দিষ্ট পাতি তোলার জায়গায় চলে যাচ্ছে। সাথের পুটলিতে পানি আর দুপুরের খাবার। অনেকেই দুপুরের খাবারে পাতিছানা নামক এক ধরনের খাবার খায়। কাঁচা চা পাতা কচলে তৈরি এই ছানা আবার বেশিক্ষণ রাখা যায় না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খেয়ে নিতে হয়; নতুবা তেতো হয়ে যায়।
দুপুর আর বিকেলটা বাংলোর সামনের সবুজ লনে বই পড়েই কেটে গেল। ছকবাঁধা জীবনে অভ্যস্ত শারাফাত ভাই ফিরবেন শেষ বিকেলে। এখানে সবকিছুই নিয়মমাফিক চলে। চা গাছের উপর থেকে সূর্যের নরম আলো পালাতে শুরু করেছে। শারাফাত ভাইয়ের মোটরবাইকের আওয়াজ পেতেই বেয়ারা বারকোশে করে পানি নিয়ে ছুটে এলো। সন্ধ্যায় আমাদেরকে কাছের এক টি এস্টেটের লেকে নিয়ে যাওয়ার কথা উনার। শারাফাত ভাইয়ের জিজ্ঞাসা, ‘লেকের আলোতে চাঁদ দেখতে চান?’ আমরা অবশ্য ধরে নিয়েছি ওটা ‘চাঁদের আলোতে লেক’ হবে! তার আগে সূর্যাস্ত দেখতে এই চা বাগানের সবচেয়ে বড়ো টিলায় উঠলাম। মোটরবাইকে চূড়া অবধি উঠা যায়। জায়গাটা বেশ সুন্দর। সবুজের রোমশ ছোঁয়া সব টিলাজুড়ে। একেবারে ঘন বাড়বাড়ন্ত সবুজ। এত সুন্দর পরিবেশে একটাই মুশকিল। এলাকার কিছু ছেলেপেলে এই টিলাকে বেছে নিয়েছে টিকটক ভিডিওর জন্য। আরও খানিকক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিল। তাদের যন্ত্রণায় তিষ্ঠানো গেল না। নামার সময়ে এক দফা মোটরবাইক নষ্ট হওয়াতে টিকটক–প্রসূত বিরতির ফুঁসকুড়ি ঘা–তে রূপান্তরিত হলো। নানান কসরত করে মোটরসাইকেল চালু হতেই সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে রওনা দিলাম মাথিউরা লেকের উদ্দেশ্যে।
সরু একটা পিচের রাস্তা ধরে এগোচ্ছি। এই রাস্তায় গাড়ির আনাগোনা একেবারেই কম। রাস্তার পাশে অসংখ্য জোনাকি। মাঝে একবার মোটরসাইকেলের লাইট বন্ধ করে জোনাকি দেখতে থামা হলো। সুন্দর এক রবার বাগানের মধ্য দিয়ে পথ চলতে চলতে রাস্তা হারালাম। গুগল ম্যাপ বলছে মূল রাস্তা থেকে দূরে সরে গিয়েছি। মাঝে মাঝে ভুল রাস্তাও দারুণ সব গন্তব্যে নিয়ে যায়। এই আধো অন্ধকার পরিবেশে রবার বাগানটাকে মনে হচ্ছে উপহারই। কালো জমাট গাছপালার ফাঁকে অনেক দূরে তারার মতো জ্বলছে গেরস্তের ঘরের বাতি। গুগল ম্যাপকে পুঁজি করে আবার ফেরত এলাম লেকের রাস্তায়। ক্ষণেক বাদেই মাথিউরা লেকে। ততক্ষণে চাঁদকে গ্রাস করেছে ঘন কালো মেঘ। কে যেন সুনিপুণ হাতে আকাশে আলকাতরা লেপে দিতে ব্যস্ত। চাঁদের নিষ্প্রভ আলোয় লেক দেখার ইচ্ছে ছিল, সেটা কিনা দেখতে হলো আকাশে চোখ রাঙাতে থাকা বজ্রের আলোয়! বৃষ্টি নামার পূর্ব প্রস্তুতিস্বরূপ ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করতেই আবার বাইকে চেপে বসলাম তিনজনে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে বাতাস আরও ভেজা হয়ে উঠল। ফিরতে ফিরতে দেখছিলাম এদিকে খানিক আগেই ঝুম বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। ভেজা পিচ, রাস্তার পাশের গর্তে জমে থাকা পানি, গাছের পাতা চুঁইয়ে পড়া টপটপ পানি– এসব তারই সাক্ষ্য দেয়। বাজারে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বাগানে ঢুকে পড়লাম। চা বাগানের কারখানার ঝলমলে আলোর বিপরিতে টিমটিমে আলো জ্বলা একটা জানালার দেখা পেলাম। ওটা চা বাগানের স্থানীয় মদের দোকান। চা বাগানের সকাল শুরু হয় শ্রমিকদের গুনতি তথা গণ্না দিয়ে। গুনতির সময়ই আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আমাদের সময়ের গুনতি তথা পুঁজি যে ফুরিয়ে এসেছে প্রায়।