মশক নিধনে ওষুধ কেনায় ‘নয়ছয়’ করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। উন্মুক্ত দরপত্র আহবান ছাড়াই পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে গত দুই অর্থ বছরে এক কোটি তিন লাখ টাকার মশক নিধন কীটনাশক ‘এডালটিসাইড’ কিনেছে সংস্থাটি। এমনকি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চুক্তির শর্ত পূরণ না করলেও মশার লার্ভা ধ্বংসকারী ‘লার্ভিসাইড’ এর জন্য ৯৯ লাখ টাকা পরিশোধ করে চসিক। এছাড়া সংগ্রহের পূর্বে পৃথক তিনটি সংস্থা থেকে ওষুধের গুণগত মান পরীক্ষার নিয়ম থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়নি। ফলে ছিটানো ওষুধ আদৌ কার্যকর কীনা সেটাও অনিশ্চিত। দৈনিক আজাদীর অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। বিষয়টি স্বীকার করেছেন চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। তিনি আজাদীকে বলেন, নানা অনিয়ম হয়েছে। কোন টেন্ডার ছাড়াই ওষুধ কেনা হয়েছে। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর যেসব এডালটিসাইড ও লার্ভিসাইড পেয়েছি সেগুলো ইফেক্টিভ না। কেনার আগে তিন জায়গা থেকে টেস্ট করতে হয়। কিন্তু কেনার পর করেছে, তাও এক জায়গা থেকে। স্টকে থাকা ওষুধ আমি চট্টগ্রামে পরীক্ষা করানোর জন্য চেষ্টা করেছিলাম। পরীক্ষা করে এমন প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় করতে পারিনি। তিনি বলেন, ফগার মেশিনও কিনেছে বিনা টেন্ডারে। ৯৩টি ফগার মেশিন কিনেছে। বছর না যেতেই ৩৩টি নষ্ট হয়ে গেছে!
অনিয়মের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নিবেন কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়াদ আর বেশিদিন নাই। অল্প কয়েকদিন আছে। এসময়ে সম্ভব না। আশা করছি, পরবর্তী মেয়র হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করবেন তিনি ব্যবস্থা নিবেন।’
দরপত্র ছাড়াই ওষুধ সংগ্রহ : ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ‘ডকইয়ার্ড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’কে ২৫ হাজার লিটার লিকুইড এডালটিসাইড কেনার কার্যাদেশ দেয় চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগ। প্রতি লিটারের দাম ছিল ৪১২ টাকা। চসিক মোট এক কোটি তিন লাখ পরিশোধ করে মূল্যবাবদ। অথচ কোন দরপত্র আহবান না করেই দেয়া হয়েছিল কার্যাদেশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর ‘ডকইয়ার্ড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’ তৎকালীন সিটি মেয়রকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি ‘ডিপিএম’ (ডিরেক্ট প্রকিউরম্যান্ট মেথড) অনুসরণ করে কার্যাদেশ প্রদানের অনুরোধ করে। এতে ৪১২ টাকা দর নির্র্ধারণ করে দিয়েছিল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি। এর প্রেক্ষিতেই কার্যাদেশ দেয় চসিক। অতচ উন্মুক্ত দরপত্র আহবান করা গেলে চসিকের অর্থ সাশ্রয় হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রতি লিটার ওষুধ ৩৭৮ টাকায় সরবরাহ করেছিল ‘ডকইয়ার্ড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’।
এদিকে কার্যাদেশটি নিয়ে আপত্তি দিয়েছে সরকারের নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগ। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) ২০০৮ এর ৬১ অনুযায়ী অনিয়মিতভাবে এক কোটি তিন লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। যা আর্থিক ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী।
উল্লেখ্য, মশক নিধনে গত ১১ বছরে ১১ কোটি ৪৫ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭ টাকা খরচ করেছে চসিক। এর মধ্যে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের মেয়াদকালে ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন কোটি ২৫ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭ টাকা খরচ হয়। আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদকালে খরচ হয় ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা।
পরীক্ষা ছাড়াই ওষুধ ক্রয় :
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কল্যাণ ট্রাস্ট’কে ২০২০ সালের ২৬ এপ্রিল ৯৯ লাখ টাকায় ১০ হাজার লিটার লার্ভিসাইড সরবরাহে কার্যাদেশ দেয়া হয়। প্রতি লিটারের দাম নির্ধারণ করা হয় ৯৯০ টাকা। একই বছরের ১৪ মে লার্ভিসাইড সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, সরবরাহের আগে পরীক্ষা করা হয়নি ওষুধ কার্যকর কীনা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে হওয়া চুক্তির এক নম্বর শর্ত ছিল, ‘মালামাল স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী এবং সার্ভে বোর্ড কর্তৃক গ্রহণযোগ্য হতে হবে।’ অথচ সার্ভে বোর্ড গঠন করে লার্ভিসাইডগুলো পরীক্ষা করা হয় নি। এছাড়া কার্যাদেশের ‘ক’ নং শর্ত ছিল সরবরাহকৃত লার্ভিসাইড অবশ্যই উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং এর স্ট্যার্ন্ডাড স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী হতে হবে। ‘জ’ নং শর্ত ছিল, মালামাল সরবরাহের পূর্বে ‘রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট’ (আইইডিসিআর) ও ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট’ ও ‘কীটতত্ত্ব বিভাগ’ থেকে পরীক্ষা করে রেজাল্ট উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু সরবরাহকৃত মালামাল উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং এর স্ট্যান্ডার্ড স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কীনা যাচাই করা হয়নি।
এছাড়া আইইডিসিআর পরীক্ষার ফলাফল প্রেরণ করা হয়েছে ২০২০ সালের ১০ জুন। অথচ লার্ভিসাইড সরবরাহ করা হয়েছে ১৪ মে। অর্থাৎ সেখানেও নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি।
এসব বিষয়ে সরকারের নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘চুক্তিপত্রের শর্ত এবং কার্যাদেশের শর্ত লংঘনপূর্বক ৯৯ লাখ টাকা ব্যয় করা সমীচীন হয়নি।’
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ঢাকায় ছিটানো ওষুধ পরীক্ষা করে ‘অকার্যকর’ বলেছিল আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি)। ওই বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে ওষুধ সরবরাহ করেছিল নারায়ণগঞ্জস্থ প্রতিষ্ঠানটি। একই বছর চসিকেও প্রতিষ্ঠানটি ওষুধ সরবরাহ করেছিল।
এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)-টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ওষুধ না কেনা এবং কেনার আগে পরীক্ষা না করাটা সবচেয়ে বড় অনিয়ম। পণ্য গ্রহণের পর তিনটা সংস্থার জায়গায় এক জায়গায় পরীক্ষা হয়েছে। এখানে পরীক্ষার জন্য যে স্যাম্পল পাঠিয়েছে তার সঙ্গে সরবরাহকৃত ওষুধের মিল ছিল কীনা সেটাও সন্দেহজনক।
তিনি বলেন, যেখানে চুরি করে টেন্ডার করা হয় সেখানে ক্রয়ের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তারা স্বচ্ছ ছিল সেটা ভাবার সুযোগ নেই। এখানে দুর্নীতি হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি একেবারে অনুপস্থিত ছিল। পণ্য নেয়ার পর পরীক্ষা করাটা একেবারে জগন্যতম অন্যায়। এ অন্যায়টা কেবল সিটি কর্পোরেশনের ফান্ড আত্মসাতের অন্যায় না, নাগরিকদের জনস্বাস্থ্যের বিষয় এখানে জড়িত। এক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার দেয়ার সুযোগ নেই। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওযা দরকার। সত্যিকার অর্থে এটা আমরা চাই। প্রশাসকের প্রতি অনুরোধ থাকবে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তদন্ত করে আইনের আওতায় আনার জন্য সুযোগ করে দিবেন।