৩০ মার্চ ২০২৩ প্রিয় বন্ধু কবি রিজোয়ান মাহমুদ আকস্মিক আমার ডেরায় উপস্থিত। সাথে ছিলেন আরেক প্রিয় কবি জিল্লুর রহমান। গল্প–আড্ডা শেষে কবি রিজোয়ান তার সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘মীরখানার ফকিরি’ আমার হাতে তুলে দিলেন। এ যেনো মুরিদের হাতে মীরখানার খাদেমের দীক্ষাগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থটি শৈলী প্রকাশন থেকে এবছর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থে মোট ৮১ টি চতুষ্পদী কবিতা গ্রন্থিত। কবিতাগুলো উর্দু কবিতা ও গজলের ঈশ্বর মীর তকি মীরের ভাবধারার আঙ্গিকে ভিন্ন সুর ও ব্যঞ্জনায় রচিত। কাব্যগ্রন্থের ফ্ল্যাপ লিখেছেন প্রিয়কবি ইউসুফ মুহম্মদ এবং বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে, আরেক প্রিয়কবি ও শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফকে।
মীর তকি মীরকে উর্দু কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছেন উর্দু সাহিত্যের আরেক কিংবদন্তি কবি মীর্জা গালিব। উর্দু সাহিত্যে গালিবের বিস্তৃতি, ব্যাপকতা ও পদচারণার জায়গায় মীর তকি মীর স্বকীয় ধারায় উজ্জীবিত ছিলেন। কথিত আছে, মোগল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠতম উপহার হচ্ছে তাজমহল ও গালিবের কবিতা এবং এই দুয়ের মধ্যে গালিবের অগ্রজ মীর তকি মীরের কবিতা–গজল হয়ে উঠেছিল উজ্জ্বল প্রদীপ শিখা। মীরের কবিতার রথে চড়ে উর্দু ভাষা নতুন পথের সন্ধান পেয়েছিল। উর্দু কবিতাকে মীর তকি জন–মানুষের ঠোঁটেমুখে তুলে দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, পাঠক পরিশুদ্ধ উর্দুভাষা পাঠে নিবিষ্ট হলো। মীর তকি মীরকে উর্দু কবিতা–গজলের ঈশ্বর বলা হতো। মূলত মীরের সৃষ্টিকর্ম প্রেম, দ্রোহ,আনন্দ–বেদনা, মরমিবাদ, দেহতত্ত্ব, দর্শনতত্ব ও আধ্যাত্মবাদে আবৃত। মীরের সরল সাবলীল ও মনোমুগ্ধকর কবিতা–গজলের ব্যঞ্জনায় গালিব নিজেই স্তব্ধ, অভিভূত হয়েছিলেন।
কবি রিজোয়ান মাহমুদের ‘মীরখানার ফকিরি’ কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থিত কবিতার শরীরে মীর তকি মীরের কবিতা গজলের ঘ্রাণ ভিন্ন সুর ও ব্যঞ্জনায় স্পর্শিত। মীর তাঁর লেখায় মোগল সাম্রাজ্যের সময়কে ধারণ ও প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, কবি রিজোয়ানও তার ‘মীরখানার ফকিরি’ কাব্যগ্রন্থে বর্তমান সময়কে ধারণ ও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কাব্যগ্রন্থের কবিতার অন্তর্নিহিত অবয়বে সময়ের যন্ত্রণা, দ্রোহ, প্রেম–বিরহ, ঈশ্বর বন্দনা, দেহতত্ত্ব, দর্শন, আধ্যাত্মবাদ, অতীন্দ্রিয়বাদ ও পরাবাস্তবতা বিদ্যমান যা কবি রিজোয়ান মাহমুদ তার চতুষ্পদী বা চার পঙতির ছন্দবদ্ধ কবিতায় শৈল্পিক কায়দায় উপস্থাপন করে অনিন্দ্য মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
কবি রিজোয়ান মাহমুদের প্রকাশিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলো যেমন; ১. গগনহরকরা ডাকে ২. নীরবপুর ৩. দুপুরলতা ৪.মুদ্রিত কামনা থেকে ৫. হাইকো চাঁদের ফ্রক ইত্যাদি আমি পড়েছি কিন্তু ‘মীরখানার ফকিরি’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার বিষয়, বৈশিষ্ট্য, নির্মাণশৈলী, স্বাদ, আবহ ও ধারাবাহিকতা সম্পূর্ণ আলাদা। চতুষ্পদী কবিতা অর্থাৎ চার লাইনের কবিতার যে কাঠামো ও ভাবগত বিন্যাস তাকে পুরো গ্রন্থজুড়ে ধরে রাখা একজন স্বভাবজাত কবির পক্ষে সম্ভব এবং কবি রিজোয়ান তা যথাযথভাবে সম্পন্ন করেছেন। যেমন দেহের মাংসপেশি প্রভৃতিকে নিয়মিত আকার দিতে হলে তার জন্য একটা শক্ত খাঁচা চাই। ঠিক তেমনি সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য আঁটসাঁট শৈল্পিক ক্ষমতা চাই। কবি রিজোয়ান তার এ কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থিত প্রতিটি কবিতায় তা খুব সূক্ষ্মভাবে বজায় রেখেছেন।
চতুষ্পদী বা চার পঙতির ছন্দবদ্ধ কবিতা যা আরবী ও ফার্সিতে রুবাই বা রুবাইয়াত হিসেবে সুপরিচিত। পারস্যের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম ও তার উত্তরসূরী কবি হাফিজের হাতে সম্ভবত চতুষ্পদী কবিতা উৎকর্ষতা লাভ করে। এ ধরনের কবিতা আকারে ছোট হলেও ভাববিন্যাসে অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। অনুরূপ কবি রিজোয়ানের ‘মীরখানার ফকিরি’ কাব্যগ্রন্থের চতুষ্পদী কবিতাগুলোর অবয়ব ছোট হলেও বিষয়–ভাব বিন্যাসে অসামান্য। একটি প্রদীপ শিখার আকার অত্যন্ত ক্ষুদ্র কিন্তু তার আলোর পরিধি অনেক বিস্তৃত। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হবে, হৃদয়ের ক্ষরিত রক্তের এক একটি বিন্দুর আকর কিম্বা সুরভিত গোলাপ পাপড়ির ফুরফুরে সৌরভ। সমুদ্রের জলে একফোঁটা জল যখন পড়ে ওই একফোঁটা জল বিশাল সমুদ্রের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায় অর্থাৎ একফোঁটা জল তখন সমুদ্রের আকার ধারণ করে। আমার মনে হয়, পাঠক যখন ‘মীরখানার ফকিরি’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করবেন তখন বিস্তীর্ণ গভীর সমুদ্রে একফোঁটা জলের অনুরূপ অস্তিত্ব অনুভব করবেন অর্থাৎ ওই রকম ভাবনার গভীরে অবগাহন করবেন।
মীরখানার ফকিরি কাব্যগ্রন্থ থেকে কয়েকটি কবিতা বা কবিতার চরণ উদ্ধৃত করলে কবিতায় সন্নিবেশিত যে অস্তিত্ব, ধরন ও প্রেক্ষাপট লক্ষণীয় তা আশাকরি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
১ নং কবিতায় কবি রিজোয়ান মীর তকি মীরের মরমি সাধনায় আকুল তা খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন-‘বনেদি রচনা লিখবো যখন আমি বনেতে না গিয়ে /মসনবি হবে কি হবে না তবু যাবো না পিছিয়ে। যতদূর থাকুক না মীর তকি মীর, খোদা–ই সুখুন/ তাওয়াফে ঝরুক মেহেদি সুরা শূন্য আকাশ দুঃখুন’। ১২ নং কবিতায় অতীন্দ্রিয় মনস্তত্ত্ব ও ঐশ্বরিক প্রেমের আকুতি অসাধারণ শাব্দিক ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত-‘ভোররাতে বহে যায় একখণ্ড নূরের হাওয়া/মা গো তুমি গোস্বা করো না হবে না যাওয়া। তোমার আঁচলে আমি,তাহাজ্জুদে বাবা/ সুঁই ও সুতোয় মুহুর্মুহু রচিত আমার কাবা’। ৩১ নং কবিতায় উদ্ভাসিত হয়েছে সামপ্রতিক সময়ের অব্যর্থ বেদনা ও নাগরিক যন্ত্রণার আক্ষরিক অনুবাদ-‘মজুদখানায় মজুদ করেছ দিনক্ষণ ঠিক/ সব ছেড়ে যেতে হবে, থাকে যতই অধিক। মন দূর হিমালয় বরফের প্রতিবেশী ক্ষণ/ বাঁকা মেঘ নাই জেনেও টানছ বিলক্ষণ’। কাব্যগ্রন্থের প্রতিটা কবিতাই ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যকল্প, নিগূঢ় অনুভূতি, উপলব্ধি ও মেজাজে রচিত অর্থাৎ প্রত্যেকটি কবিতা স্বতন্ত্র আবহে প্রবহমান যা কবিতাগুলোকে অসাধারণ স্বাতন্ত্র্য ব্যঞ্জনা দিয়েছে। এখানেই কবির কাব্য শক্তি ও মৌলিকত্বের পরিচয়। মীর তকি মীরকে তিনি পড়েছেন, অনুভব, উপলব্ধি করেছেন এবং মীরের কবিতার প্রতি তার অপার অনুরক্তি ছিলো, হৃদয়োৎসারিত ভালোবাসা ছিলো কিন্তু “মীরখানার ফকিরি” কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থিত কবিতার মৌলিকত্বের প্রশ্নে কবি রিজোয়ান মাহমুদ প্রশ্নাতীত স্বকীয়তাবোধ বজায় রেখেছেন।
আমি মনে করি, ‘মীরখানার ফকিরি’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা সাহিত্যপ্রেমি ও সর্বস্তরের পাঠককে আকর্ষণ করবে। কবিতায় বৈচিত্র্যময় অনুরণন ও আবেগের সন্ধান পাবে যা পাঠককে অন্যরকম প্রশান্তি ও মুগ্ধতার খোরাক যোগাবে। বারবার পড়ার তাগিদ দেবে। কবি রিজোয়ানে মাহমুদের ‘মীরখানার ফকিরি’ কাব্যগ্রন্থটি নিঃসন্দেহে পাঠক সমাদৃত হবে।
লেখক : কবি