চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়েছে দুই হাজারের বেশি কন্টেনার। এতে আছে কয়েক হাজার কোটি টাকার রপ্তানি পণ্য। দুটি কন্টেনার জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় রপ্তানি পণ্য বোঝাই এসব কন্টেনার আটকা পড়ে। এতে রপ্তানি বাণিজ্যে সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এমভি হাইয়ান সিটি জাহাজের ৭ শতাধিক কন্টেনারের কোনো ব্যবস্থা হয়নি। এর মাঝে রপ্তানি পণ্য বোঝাই ১৩শ কন্টেনার নিয়ে এমভি এক্সপ্রেস কোরিমা নামের আরেকটি জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আটকা পড়ে। নিয়ন্ত্রণহীন একটি বার্জ জেটিতে নোঙরে থাকা এক্সপ্রেস কোরিমাকে ধাক্কা দিলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এর ফলে সমুদ্র পাড়ি দেয়ার অযোগ্য হয়ে পড়া জাহাজটিকে মেরামত করতে পাঠানো হয়েছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে আটকে থাকা হাইয়ান সিটির পাশাপাশি এক্সপ্রেস কোরিমার রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনারগুলো আটকা পড়ায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনালের ৩ নম্বর বার্থে থাকা এক্সপ্রেস কোরিমা নামের একটি কন্টেনার জাহাজকে মদিনা–৭ নামের একটি বার্জ গত সোমবার বিকালে ধাক্কা দেয়। ওই সময় জাহাজটিতে রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার লোড ও আমদানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার খালাস করা হচ্ছিল। ১৩শ টিইইউএস রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনারের মধ্যে ১৮০ টিইইউএস লোড করার সময় টাগবোট টাইগার–৩ এর সহায়তায় চলা নিয়ন্ত্রণহারা বার্জটি কোরিমাকে ধাক্কা দেয়। এতে জাহাজটির পোর্ট সাইড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাহাজটির বডিতে ফুটো হয়ে যায়। তবে ফুটোটি পানির লেভেলের উপরে হওয়ায় জাহাজটি বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে। ওই ফুটো দিয়ে পানি ঢুকলে জাহাজটিকে রক্ষা করা কঠিন হতো বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বন্দর সূত্র জানায়, দুর্ঘটনার পরপর জাহাজটিতে রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার লোডিং বন্ধ করে দেয়া হয়। আমদানিকৃত কন্টেনারগুলো খালাস কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। গতকাল সকালে জাহাজটির আমদানি পণ্য বোঝাই সবগুলো কন্টেনার খালাস করার পর এটা মেরামতের জন্য টিএসপি জেটিতে পাঠানো হয়েছে।
জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট সী কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ লিমিটেডের শীর্ষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম গতকাল আজাদীকে জানান, জাহাজটির মাধ্যমে রপ্তানি পণ্য বোঝাই ১৩শ কন্টেনার কলম্বো যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৮০ কন্টেনার বোঝাই করার পর বার্জের ধাক্কায় জাহাজটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে জাহাজটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এটিকে মেরামত করার জন্য টিএসপি জেটিতে স্থানান্তর করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জাহাজটি সার্ভে করা হচ্ছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর কিভাবে মেরামত করা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এতে কমপক্ষে ৭/৮ দিন সময় লেগে যাবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের অপর একটি জাহাজ এমভি এক্সপ্রেস লচ্ছি আজ বন্দরে এসে পৌঁছেছে। এই জাহাজটিও ফিরতি পথে রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার নিয়ে যাবে। জাহাজটি পুরোপুরি ভর্তি। এতে করে এমভি এক্সপ্রেস কোরিমার সব কন্টেনার একটি জাহাজে জায়গা দেয়া অসম্ভব। তবে রপ্তানিকারকেরা যদি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাহলে এই জাহাজটিতেও কয়েকটি কন্টেনার কলম্বোর জন্য তুলে দেয়ার চেষ্টা করা হবে।
এর আগে ১৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৭১৮ টিইইউএস রপ্তানি পণ্য বোঝাই এবং ৩৮৭ টিইইউএস খালিসহ মোট ১১০৫ টিইইউএস কন্টেনার নিয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার পথে বাংলাদেশি অয়েল ট্যাংকার এমটি ওরিয়ন এক্সপ্রেসের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে হাইয়ান সিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাহাজটিতে পানি ঢোকে। পরে জাহাজটিকে কুতুবদিয়া থেকে বন্দর চ্যানেলে ফিরিয়ে আনা হয়। বর্তমানে জাহাজটি মেরামতের কাজ চলছে। এই জাহাজের ৭১৮ টিইইউএস রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার আটকা পড়েছে। এসব কন্টেনার সিঙ্গাপুর থেকে মাদার ভ্যাসেল ধরে ইউরোপ, আমেরিকায় যাওয়ার কথা থাকলেও পণ্যগুলো গন্তব্যে পৌঁছেনি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এসব পণ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।
সোমবার দুর্ঘটনায় নতুন করে ১৩শ কন্টেনার আটকা পড়ায় ব্যবসায়ীদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এসব কন্টেনার কলম্বো থেকে ইউরোপ, আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল। এই জাহাজের কন্টেনারগুলো কবে কলম্বো পৌঁছাবে বা আদৌ মাদার ভ্যাসেল কানেকশন রক্ষা করতে পারে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা উদ্বিগ্ন। উপর্যুপরি দুটি দুর্ঘটনায় দুটি জাহাজে দুই হাজারেরও বেশি রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার আটকা পড়েছে। এর ৮০ শতাংশেরও বেশি তৈরি পোশাক। এসব পোশাক তৈরি এবং রপ্তানি করলেও তা সময়মতো না যাওয়ায় কোনো পেমেন্ট পাচ্ছি না। এসব পণ্য সময়মতো মাদার ভ্যাসেল ধরতে না পারলে অর্ডার ক্যান্সেলের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
তিনি বলেন, ইউরোপ, আমেরিকার পোশাকগুলো সিজননির্ভর। দুই–চারদিন এদিক–ওদিক হলেও অনেক সময় তারা পণ্য রিসিভ করে না। দর কমাতে বাধ্য করে। এই দুটি জাহাজের পণ্যগুলোর ভাগ্যে কী ঘটবে তা নিয়ে শিল্পপতিদের মাঝে উদ্বেগ রয়েছে। এই ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা একটির পর একটি কেন ঘটল তা খতিয়ে দেখা এবং তা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।