ঘটনা প্রায় ৩৩ বছর আগের; যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন স্বৈরাচারী এরশাদ। তবে সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সাংবাদিক ও সাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী নিপুণ দক্ষতায় ফিরে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। আর পরিচালক পঙ্কজ পালিত সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা পর্দায়। বলছিলাম চলচ্চিত্র ‘একটি না-বলা গল্প’ বিষয়ে। যার প্রেক্ষাপট ১৯৮৮ সাল। তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে বছরের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার জনসভা ছিল। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার বিরোধী মিছিল নিয়ে জনসভায় পৌঁছে যায়। সভা শেষ হওয়ার আগেই বাধে বিপত্তি। পুলিশ বিনা উসকানিতে গুলি ছোড়ে। কালো রাস্তার পিচ রক্তে লাল হয়ে যায়।
ঘটনাস্থলেই বেশ কয়েকজন মারা যান। তাঁদের মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও ছিলেন। ইতিহাসে ঘটনাটি ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ হিসেবে পরিচিত। তাঁর গল্প নিয়েই মূলত সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন পঙ্কজ পালিত। ছবিতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সন্তানকে সামনে রেখে মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি সূত্রে উঠে আসে ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত এ গল্পের পরতে পরতে রয়েছে উত্তেজনা, যা দর্শককে গতকাল শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে মনের অজান্তে; শিল্পিত ভাষ্যে।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে তৈরি সরকারি অনুদানের ছবি ‘একটি না বলা গল্প’র প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রামে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী হয়। ‘একটি না বলা গল্প’ ছবির সবচেয়ে অসাধারণ দিক হচ্ছে এর গল্প। খুব চমৎকারভাবে গল্পকার মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন। পরিচালকও আন্তরিকভাবে তা পর্দায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি চট্টগ্রামের সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানুষকে বেশি উদ্বুদ্ধ করা যায়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি নারকীয় হত্যাকাণ্ড পুরো দেশকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। এত মানুষকে কিভাবে হত্যা করা হতে পারে তা মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছিল। এ ঘটনাটিই গল্পে রূপ দিয়েছেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী। গুলিবিদ্ধ এক ছাত্রের পিতা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ৭১’র ঘটনা প্রবাহকে এনেছেন ৮৮ সালে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালক সেই ঘটনা প্রবাহকে চিত্রায়িত করেছেন। আশা করি, তা মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিহাসকে ধারণ করতে এ ধরণের চলচ্চিত্র প্রয়োজন মন্তব্য করে মেয়র রেজাউল বলেন, একাত্তরের ইতিহাসকে এ ভাবে তুলে ধরুন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনেকে রক্তাক্ত হয়েছেন, ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন। নতুন প্রজন্ম সে সব ইতিহাসকে জানলে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিতে পারবে না। চলচ্চিত্রই পারে প্রজন্মকে এমন ইতিহাস সচেতন করতে। তিনি আরো বলেন, সৃষ্টিই মহত্ব। সৃজনশীলতা দিয়ে পরিচালক নতুন কিছু সৃষ্টি করেছেন। আসুন সবাই এমন কাজে এগিয়ে যাই। পৃষ্ঠপোষকতা করি ভালো কাজের।
বিশেষ অতিথি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ সালাম বলেন, ৫০ বছর আগের ইতিহাস ছবিতে তুলে আনা অত্যন্ত কঠিন কাজ। আমাদের ২৩ বছরের সে সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে শত ছবি হতে পারে। ৯ মাসের প্রতিটি দিন নিয়ে একেকটি মহাকাব্য লেখা যাবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। অনেক মিথ্যা তথ্যও এসেছে। স্বাধীনতার পরপর কিছু চলচ্চিত্র হয়েছিল। কিন্তু এখন আর তেমন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবি হয় না। ‘জীবন থেকে নেয়া’ জহির রায়হানের এ ছবি স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছে। এম এ সালাম বলেন, এখনকার জেনারেশনতো বই পড়তেই চায় না। তাই একটা বড় সুযোগ চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্জন, ত্যাগ নতুন প্রজন্মকে জানানোর মধ্য দিয়েই কেবল দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা যাবে। দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী ছাড়া উন্নত দেশ, উন্নত জাতি গঠন সম্ভব না।
চলচ্চিত্রটির পরিচালক পঙ্কজ পালিত বলেন, বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘মৃত্যু যেভাবে বাঁচায়’, গল্পটি একদিন চায়ের টেবিলে পড়ি। তখনো যোগাযোগ ছিল না। পরে উনার সাথে আলাপ হয়। এ ছবির কাহিনী চট্টগ্রামের একটি পরিবারকে ঘিরে। তাই উদ্বোধনী প্রদর্শনীটি চট্টগ্রামেই হোক। বাণিজ্যিক ধারার ছবি নির্মাণে আমি কখনই যাব না। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কেমন ছিল তা অনেকেই জানেন না।
গল্পকার বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, অনেক আগে এ গল্পটি লেখা। মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছি একেবারে শৈশবে। তাই গল্পটি লেখার সময়ে গণআন্দোলনের সময়ের ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারিকে সামনে রেখে ফ্লাশব্যাকে ১৯৭১ এর ঘটনাবলী বর্ণনা করতে চেয়েছি। আমরা সবাই মিলে তখন রাজপথে ছিলাম। সেদিন বলুয়ার দীঘির শ্মশানে কোনো ধর্ম পরিচয় না জেনে অনেককে দাহ করা হয়েছিল। এ নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করি ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ নামে। একটি ৫ পাতার গল্পকে সিনেমায় রূপ দেয়া কঠিন কাজ। পরিচালক অত্যন্ত দক্ষতায় তা সম্পন্ন করেছেন।
অভিনেতা সুনীল ধরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিনেমাটির দুই অভিনেতা আরিফ হক ও রাকিব হোসেন।