বাণিজ্যিক মোটরযানের ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণের ফলে চট্টগ্রামে ২৫ হাজারের বেশি বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান স্ক্র্যাপ করতে হবে। চট্টগ্রামের বিআরটিএ থেকে রেজিস্ট্রেশন নেয়া দুই লক্ষাধিক গাড়ির অন্তত বিশ হাজারের কোনো ফিটনেস সনদ নেই। এসব গাড়ির আয়ুষ্কালও নেই। পাকিস্তান আমলের গাড়িও এখনো চট্টগ্রামের কোনো কোনো এলাকার রাস্তায় চলাচল করছে। সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে এসব যানবাহন স্ক্র্যাপে পরিণত হবে। তবে মোটরযান মালিকরা এর প্রতিবাদ করে বলছেন, এটা জনস্বার্থবিরোধী এবং আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। সূত্রে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনা কমানো, যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পরিবেশ দূষণ হ্রাসের লক্ষ্যে সরকার বাণিজ্যিক মোটরযানের লাইফ টাইম নির্ধারণ করেছে। বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের ক্ষেত্রে নতুন এই আইন প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্তে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। একই সাথে ‘মোটরযান স্ক্র্যাপ নীতিমালা, ২০২৩’–এর খসড়াও প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত গেজেটে বলা হয়েছে, সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮–এর ধারা ৩৬–এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে ২০ বছর এবং ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানসহ পণ্যবাহী মোটরযানের ক্ষেত্রে ২৫ বছর আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই আইন ইতোমধ্যে কার্যকর করার যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলে চট্টগ্রামে ২৫ হাজারের বেশি বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ যাত্রী এবং পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত গাড়ি স্ক্র্যাপ করে ফেলতে হবে। বিআরটিএর তত্ত্বাবধানে এসব গাড়ি স্ক্র্যাপ করতে হবে। সরকারের এই নির্দেশ লংঘন করলে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’–এর ১০৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে, যাতে ধারাটি লংঘন করার অপরাধে তিন মাসের কারাদণ্ড বা ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।
গেজেটের কপি চট্টগ্রামে পৌঁছার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) চট্টগ্রামের পদস্থ একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হবে। যেসব বাস ও মিনিবাসের বয়স ২০ বছর এবং ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানসহ পণ্যবাহী গাড়ির বয়স ২৫ বছর হয়ে যাবে সেগুলোকে আর সড়কে চলতে দেয়া হবে না। এসব গাড়ি স্ক্র্যাপ করে ফেলা হবে। গাড়ির প্রস্তুতকাল থেকেই বয়স হিসাব করা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বিআরটিএ থেকে ২ লাখ ২৫ হাজারের মতো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় সংখ্যা মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলের কোনো ফিটনেস সনদ নিতে হয় না। অন্য গাড়িগুলোকে নিয়মিত ফিটনেস সনদ নিতে হয়। আগে এক বছরের জন্য ফিটনেস দেয়া হলেও এখন দুই বছরের জন্য দেয়া হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে অন্তত ২০ হাজার বাস, ট্রাক কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন গাড়ি ফিটনেস নবায়ন করেনি। এসব গাড়ির কোনো ফিটনেস নেই। এগুলো রাস্তায় চলাচলের কোনো সুযোগ না থাকলেও চলাচল করে। এসব গাড়ির বয়স ৩০–৪০ বছর। এমনকি ৫০ বছরের বেশি পুরনো গাড়িও রয়েছে। দীর্ঘদিনের পুরনো গাড়িগুলো রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে নানাভাবে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হচ্ছে এসব গাড়ি প্রচুর কার্বন নিঃসরণ করে পরিবেশ ধ্বংস করছে। সড়কের নিরাপত্তা এবং পরিবেশ রক্ষার জন্যই পুরনো গাড়িগুলো স্ক্র্যাপ করে ফেলা হবে। সরকারি সিদ্ধান্ত দেশের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিআরটিএর অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, ফিটনেস রয়েছে এমন গাড়িগুলোর মধ্যেও হাজার হাজার পুরনো গাড়ি রয়েছে। এসব গাড়ি জোড়াতালি দিয়ে চলে। এগুলোর ফিটনেস রয়েছে, তবে এখন থেকে ২০ বছরের বেশি পুরনো বাস, মিনিবাস এবং ২৫ বছরের বেশি পুরনো ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানকে আর ফিটনেস সনদ দেয়া হবে না। এগুলো ফিটনেসের জন্য এলে জব্দ করা হবে।
২০ ও ২৫ বছরের পুরনো বাস–ট্রাককে সড়কে চলাচল করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে উল্লেখ করে মোটরযানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর ওই কর্মকর্তা বলেন, রাস্তায় পুরনো গাড়ি নানা দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এসব গাড়ি স্ক্র্যাপ করে পুরো সেক্টরটিকে নিরাপত্তা বলয়ে নিয়ে আসা হবে।
এদিকে মোটরযান মালিকদের পক্ষ থেকে সরকারি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা হচ্ছে। গতকাল একাধিক মালিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভারতীয় ট্রাক–কাভার্ড ভ্যানের ব্যবসা বাড়াতে সরকার জনস্বার্থবিরোধী এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বলেন, লোহা কোনোদিন পুরনো হয় না। ২০–২৫ বছর সময় একটি গাড়ির জন্য সাধারণ ব্যাপার। এই সময়কালে গাড়ির তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। একেকটি গাড়ি অনায়াসে ৪০–৫০ বছর চলাচল করতে পারে। কিন্তু ২০ বছরে বাস এবং ২৫ বছরে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান জাতীয় গাড়িকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলে মানুষ এবং পণ্য পরিবহনে দেশব্যাপী ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। মানুষ দুর্ভোগে পড়ে যাবে, পণ্য পরিবহন ব্যয় বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে।
চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি জহুর আহমদ, মহাসচিব গোলাম রসুল বাবুল এবং অতিরিক্ত মহাসচিব হাজী মোহাম্মদ ইউনুছ বলেছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সারা দেশে বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। যে কোনো গাড়ির ইঞ্জিন পাল্টে ফেললে সেটি নতুন আয়ু পায়। দেশে পুরনো ইঞ্জিন আমদানি করার অনুমোদন রয়েছে। প্রচুর ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। পুরনো গাড়িগুলো ইঞ্জিন পাল্টে ভালোভাবেই চলাচল করে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে।