স্বাধীনতার পাশাপাশি আমাদের অর্জনের ফিরিস্তি কম নয়। পাকিস্তানী শাসন শোষণের অবসান, বাঙালির স্বাধীকার প্রতিষ্ঠা, সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন, মুক্ত সংস্কৃতি চর্চা, ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় কাঠামো, মুক্ত বুদ্ধির চিন্তা, গবেষণা ও সাহিত্য চর্চার নতুন নতুন দিকের উন্মোচন এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রশাসনিক পুন:বিন্যাসের ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় সূচিত হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী বিশেষতঃ আশির দশক বা উনিশশত বাহাত্তর পরবর্তী এবং আশির দশকের সময়কালে দেশের সংস্কৃতি তথা সংগীতের জগতে এক যুগান্তকারী অভাবনীয় উন্মেষ ও সংযোজনের সময় বয়ে চলে। মানুষের কানে, হৃদয়ে, ভাবে, অনুভবে, চিন্তায়, কামনায়, ধ্যানে, নতুন কথায়, নতুন ভাব, নতুন সুর, তাল, এসে যেমন প্রচণ্ড রকম নাড়া দেয় তেমনি আবার অন্যদিকে সংগীত জগতে যুক্ত হয় কিছু নতুন উপাদান বিদেশী ড্রাম, গীটার, কঙ্গো, বঙ্গো সহ নানা ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি। নতুন তাল সুরের উন্মাদনা। যাতে ছিল পশ্চিমা সংগীতের বিভিন্ন বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজী ব্যান্ড দল সমূহের প্রচণ্ড প্রভাব।
মূলত স্বাধীনতা পূর্বকালেই চট্টগ্রামে ব্যান্ড সংগীতের গোড়াপত্তন হয়। সে সময় ব্যান্ড সংগীত সাধারণের কাছে তেমন পরিচিত ছিল না। তখন এটাকে পপ সংগীত বা পপ গান হিসেবে কেউ কেউ জানতো। সত্তরের দশক তথা ১৯৬৫ ইং থেকে চট্টগ্রামে পপ গানের চর্চার শুরু হয়।
প্রথম যে দলটি শুরু হয় তার নাম ‘জিংগা গোষ্ঠী’। নাজমা জামান, শায়লা জামান, শফিকদের পারিবারিক আবহে এই দলের সৃষ্টি হয়। এই দলের মূল গায়ক ছিল ওমর খালেদ রুমী। ওমর খালেদ রুমী বাংলাদেশের প্রথম বাংলা ব্যান্ড গানের শিল্পী। সংগীত বোদ্ধা ও ইতিহাসবিদদের মতে ‘জিংগা’ একটি পারিবারিক ঘরানার ব্যান্ড। কারো কারো মতে এটি বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড। এমনকি ইন্টারনেটেও কোন কোন ইতিহাসবিদক ‘জিংগাকে’ এদেশের প্রথম বাংলা ব্যান্ড বলে উক্তি করেছেন।
১৯৬৭ সালে আর একটি গোষ্ঠী আত্ম প্রকাশ করে তার নাম ‘লাইটেনিংস’। ‘লাইটেনিংস’ পূর্ব পাকিস্তানের সংগীত জগতে প্রচণ্ড আলোড়ন তোলে। নোয়েল, নিউ ম্যান্ডেজ, শাকিল, ফরিদ এই চার সদস্যদের লাইটেনিংস। বিটলস প্রভাবিত এই দশটি কেবল ইংরেজী গান পরিবেশন করতো। এর মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে অর্কেষ্ট্রা দল ‘দ্যা মন্ডলস’, ‘ব্লু–হারমনি’। সত্তর দশকের শেষের দিকে জন্ম নেয় বাংলা ব্যান্ড ‘বালার্ক’। সেই সময় এই দলের সদস্য ছিলেন জিলু খান, হাসনাইন আহমেদ, আবু তাহের চিশতি সহ আরো অনেকে।
১৯৬৫ সালে প্রখ্যাত প্যারোডি গায়ক সংগীত পরিচালক জেকব গায়েসের হাত ধরে প্রাণ পায় ‘বেসুরো’ শিল্পী গোষ্ঠী। যার সঙ্গে মুক্ত ছিলেন একঝাঁক উঠতি তরুণ তরুণী গায়ক–গায়িকা সহ অনেক মিউজিসিয়ান। মাহবুব, আরমান, সেলিম, ফরহাদ, কাঞ্চন, বেবী, বণী দাস, হানিফ, রতন, হাবির, আইরীন, চার্লস, নাহার, ইষিতা, রবিন, কাজল, বাবলু, নুরী বেগম, সীমা দাস, বিলু সহ আরো অনেকে। এর দু’বছর পর গঠন করেন ‘এপোলো’ অর্কেষ্ট্রা। স্বাধীনতাউত্তর কালে সেই ‘বেসুরো’ শিল্পী গোষ্ঠী ‘স্পাইডার’ ব্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পায় সারা দেশ জুড়ে। চট্টগ্রামের তখন এমন কোন শিল্পী ছিলনা যিনি জেকব ডায়েস তথা স্পাইডার এর সাথে যুক্ত ছিলেন না। যেমন অনুপ পাল, স্বপন, জেমস্, সারোয়ার পান্চু, রতন ফরহাদ, এনিটা, সিরিল, নোয়েল, আনন্দ, শিবু, উত্তম, শেলী, শিলভী, র্ড্যাগী, বাবুল, বাদল, নিঝুম এবং সানি।
পরবর্তীতে ঐ দলে যুক্ত হয় ভোকাল ইকবাল হায়দায়, লীড গীটারে মো. আইয়ুব প্রকাশ আইয়ুব বাচ্চু, ব্যাজ গীটারে সোহেল, ড্রামে দুলাল, ভোকালে যথাক্রমে মনসুর, জাহাঙ্গীর, জুলিয়ানা, শেলী, সৈকত দাস, সীমা, সাইফুদ্দীন মাহমুদ খান, আলমগীর, শিল্পী রানী এবং পার্কিউশনে মো: আলী যুক্ত হয়।
১৯৭২ সালের মার্চের শেষের দিকে সাজেদ–উল–আলম, লুলু ও সুব্রত বড়ুয়া রনি। ‘লাইটেনিংস’ এর অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে সুরের মাদকতায় মুগ্ধ হয়ে নিজেরা একটি সংগীত দল গঠনের তাগিদ অনুভব করেন এবং এরই ধারায় ‘সুরেলা’ নামে একটি সংগীত দল গঠন করেন। পরবর্তীতে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক মাহবুবউল আলমের দেওয়া নাম ‘সোলস’ই পূর্ণাঙ্গ ব্যান্ড দলের রূপ লাভ করে। সাজিদ–উল–আলম, শাহেদ, সুব্রত বড়ুয়া রনি, তপন চৌধুরী, নকীব উদ্দীন খান, পিলু খান, র্যালী, জ্যারেট, রউফ এবং পরবর্তীতেস লীড গীটারে আইয়ুব বাচ্চু ও ব্যাস গীটারে মোঃ আলী এবং পারর্কিউশন ও ম্যানেজার হিসেবে আহমেদ নেওয়াজ যোগদান করে।
১৯৭৭ সালে কুমার বিশ্বজিৎ, ইকবাল হায়দার, প্রবাল চৌধুরী, উমা ইসলাম পরবর্তীতে উমা খান, কল্পনা লালা, নিজাম উদ্দীন, শংকর মিলে ‘রিদম ৭৭’ দল গঠন করে। মঞ্চ টেলিভিশন ও বিবিধ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে অনেক সুনাম অর্জন করে। ১৯৭৮ এ দল ভেঙে গেলে ইকবাল হায়দার ভোকাল হিসেবে স্পাইডারে যোগ দেন।
১৯৮০ সালে মংগু, পেবলো, জেমস, জ্যারেট, ফান্টি ও কুমার বিশ্বজিৎ মিলে গঠন করে ‘ফিসিংস’ নামে একটি ব্যান্ড দল। বিশ্বজিৎ, জেমস ও ফান্টি ঢাকা চলে গেলে দলটি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
১৯৮৫ সালে একঝাঁক তরুণের মিলিত প্রয়াসে ‘স্পার্ক’ নামে আর একটি দল আত্মা প্রকার করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মতিন, গিয়াস, কাজল, রহিম, ইকবাল, শাহজাহান, একরাম, টন্টি, সঞ্জয়, সাবু বাসেত, জামাল, সোহেল, টুটুল ছিল ঐ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
১৯৮৬ সালে ‘রুট্স’, ১৯৮৭ সালে জেমিং, আর ৮৮ তে সৃষ্টি হয় ‘মেসেজ’ নামে আরো কয়েকটি দল। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে ব্যান্ড জগতে চট্টগ্রামের কিছু উৎসাহী, উদ্যমী, প্রতিশ্রুতিশীল ও মেধাবী সংগীত শিক্ষার্থী নিয়ে জেকব ডায়েস গঠন করেন বাংলাদেশের একমাত্র ও প্রথম মহিলা ব্যান্ড দল ‘ব্লু–বার্ডস’। ঐ বছর ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা মঞ্চে এক সফল আয়োজন ও সুন্দর সাবলীল নিজস্ব ঢঙে পরিবেশনার মাধ্যমে সবাইকে তাক লাগিয়ে সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিটিভি সহ মঞ্চ, বিবিধ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে সব মাধ্যমে সাড়া জাগায় তাদের মৌলিক পরিবেশা দিয়ে। আনজুম আরা, রুশনী, ডলি, বেলী আফরোজ, মিনা, কেয়া, শিমুল ও রেখা ছিল বিবিধ ভূমিকায় ভোকাল ও মিউজিশিয়ান হিসেবে।
তারপর ১৯৯০ এর দশকে একে একে গ্রীণপীচ, ধ্রুবতারা, রিভার্ব, রিদম, চিয়ার্স, সিটি ভয়েজ, অর্কিড, আসওয়াদ, উইনার্স, লিরিকন, স্টিলায়, প্রিনন, প্রীজম, রিসেন্ট, উইংস, রিদম, ওয়ারিয়রস, প্ল্যার্টস, হার্টস, স্পীনাচ, উইলস, স্পিড, রাইমস, ডেজার্ট, রিমাইন্ডার্স।
এছাড়াও নব্বই এর দশকে আত্মপ্রকাশ করে কিছু অসাধারণ ব্যান্ড যেমন অরণ্য, আর্তনাদ, অন্তিম, অন্বেষা, আমসু এ্যামিথিউর, ব্ল্যাক হার্ট, বর্ণ, ব্ল্যাক ওয়ারিয়র, ব্ল্যাক সিন, বিসর্গ, বনসাই, কেকটাস, কের্সকাড, ড্রিমস, দ্রাঘিমা, দিশারী, দ্বিতীয় পৃষ্ঠা, ডিভাইন, ইস্কপ, আর্থ, এনার্জি, সোল, ফেরারী, সেইফ, প্রিডম, জিপসী, হেভেন, হার্ট রিলেশন, ইন চিটাগাং, জোবিয়াল, ওয়ার ফেয়ার সহ আরো অনেক দল।
এছাড়াও ব্যান্ড দল গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এখনো সক্রিয় আছেন ইকবাল, আহমেদ রনি, জুলফিকার, মহসিন, আনোয়ার, তাহিম, সরওয়ার, তামিম, মান্না, সাইমু, জিয়া খান, রকীবুল, সরোয়ার, শাহাদাত, রাশেদ, মাইমুল হক, জুবাইয়েদ, এনামুল হক, আজাদ, মামুন, মিজান, মুজিব, প্রান্ত, জসীম উদ্দীন, ইকবাল পিন্টু, আতাউল, তাজুল ইসলাম টুটুন, জাহাঙ্গীর আলম, সাইফুর উদ্দীন সিদ্দিক, মো: মহসিন, জাবেদ, মো: রাসেল, জানে আলম রনি, পিয়াল রহমান, এরশাদ উল্লাহ প্রমুখ।
ব্যান্ড সংগীতের উর্বর ভূমি চট্টগ্রাম। বাংলাদেশ সমবয়সী চট্টগ্রামের ব্যান্ডসংগীত। এটা অনস্বীকার্য যে, দেশের সেরা দলগুলোর বেশির ভাগই জন্ম বা বেড়ে উঠা চট্টগ্রামে। তাই বন্দর নগরী সাগর পাহাড় ও নদীর চট্টগ্রামকে বলা হয়, ব্যান্ডসংগীতের সুতিকাগার। কুমার বিশ্বজিৎ তপন চৌধুরী, নকীব খান, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, পার্থ বড়ুয়া, এস আই টুটুল, বেলী আফরোজ, সুমন কল্যাণ, মুকিত জাকারিয়া (বর্তমানে অভিনয়ে), ফান্টি (নগর বাউল ড্রামার), টন্টি (ফিডব্যাক এর ড্রামার), জিমি (নগর বাউল ড্রামার), বাবু (চিরকুট এর ড্রামার)। উল্লেখ্য যে, ফান্টি টন্টি দুই ভাই এবং জেমি, বাবু দুই ভাই চট্টগ্রাম থেকে উঠে আসা দুর্দান্ত ড্রামার যারা বাংলাদেশের সেরা ব্যান্ডগুলোতে বাজিয়ে চলেছে দুর্দান্ত প্রতাপে।
চট্টগ্রামে এখন কয়েক ঘরানার কয়েক ডজন ব্যান্ড কাজ করছে। চট্টগ্রাম মিউজিক্যাল ব্যান্ড এসোসিয়েশনের (সিএমসিএ) তালিকা অনুযায়ী চট্টগ্রাম দুই শতাধিক ব্যান্ড রয়েছে। অধিকাংশই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বিবিধ সামাজিক কর্পোরেট অফিস সহ বিবিধ মিডিয়ার তাদের সৃষ্টি করা সংগীত পরিবেশন করে আসছে। এ দলগুলো চট্টগ্রামের ব্যান্ডের সুনামকে ধরে রেখেছে নিয়মিত শো ও চর্চার মাধ্যমে। বিদেশী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, পশ্চিম ও বলিউড ছবির গানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যান্ডগুলো তাদের অসাধারণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগীত শিল্পী