গাছ কেটে ফুটপাতে ৬৬ দোকান

বরাদ্দের অনুমতি দিয়েছে চসিক

সিএনএ প্রতিবেদন | বুধবার , ৩ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ

গাছ কেটে ফুটপাতের উপর দোকান করার লিখিত অনুমতি দিয়েছে নাগরিক সুবিধা দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। ‘অতীতের মেয়র ও প্রশাসকরা এসব বরাদ্দ দিয়ে গেছেন। তা বাতিল করা কঠিন’, মন্তব্যে দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছেন বর্তমান মেয়র রেজাউল করিমও।
নগরীর বায়েজিদ থানাধীন তারা গেট ও শেরশাহ এলাকায় ফুটপাতের উপর সর্বমোট ১৮৯টি দোকান বরাদ্দ পরবর্তী নির্মাণের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশের জের না কাটতেই নগরীর টেক্সটাইলে মোড়ে পাঁচদিনের ব্যবধানে বারো ফুট প্রস্থের ফুটপাত দখল করে তৈরি করা হয়েছে আরও ৬৬টি পাকা দোকান। এসব পাকা স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে রাতের আঁধারে কাটা হয়েছে ফুটপাতে থাকা বেশকিছু গাছ। কৌশলে আরও কিছু গাছ দোকানের মধ্যে রেখেই দেয়াল তুলে ফেলা হয়েছে। সুযোগ বুঝে সেগুলোও কাটা হবে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেখানে হকার সেজে দোকান বরাদ্দ নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও। যেমন ঃ ৬৫ নম্বর দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন সালাউদ্দিন। তিনি জালালাবাদ ওয়ার্ডের যুবলীগ নেতা। একইভাবে, ৬৪ নম্বর দোকান নিয়েছেন বাহার উদ্দিন, ৬৩ নম্বর দোকান নিয়েছেন শামসুদ্দিন বাদল, ৬২ নম্বর দোকান নিয়েছেন শাহ জাহান ছাড়াও আরো অন্তত ৮/১০ জন আছেন বরাদ্দপ্রাপ্তের তালিকায়। যারা স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
যা বললেন চসিক মেয়র : সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নগরীর কোথাও কোন ফুটপাত কিংবা ভূ-সম্পত্তি বরাদ্দ দেননি তিনি। টেঙটাইল, শেরশাহ ও তারাগেট এলাকায় ফুটপাতে যেসব দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা সাবেক প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন দিয়ে গেছেন। ফুটপাতে দোকান বরাদ্দ দেয়া বৈধ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, শহরের এমন কোন সড়ক এবং ফুটপাত নেই যেখানে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়নি। অতীতে মেয়র, প্রশাসকরা যেসব সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন তা বাতিল করা কঠিন। সিটি কর্পোরেশনকে আইনি জটিলতায় পড়তে হবে।
মেয়র বলেন, সকালে ফুটপাত দখলমুক্ত করলে বিকালে আবার দখল হয়ে যায়। পুলিশের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত রাখা সম্ভব নয়। হয়তো সেই বিবেচনা থেকে অতীতে এসব দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে দোকানগুলো দেয়া হয়েছে অস্থায়ীভিত্তিতে। সড়ক সম্প্রসারণের প্রয়োজন হলে যেকোন সময় এসব দোকান উচ্ছেদ করা যাবে।
সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, টেঙটাইল মোড় থেকে চন্দ্রনগরমুখী সড়কের দুপাশের ফুটপাতে পাকা দোকান নির্মাণের কাজ চলছে। প্রায় ১২ প্রস্থের ফুটপাত দখল করে এসব দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে। ফুটপাতজুড়ে বেশকিছু গাছ কেটে ফেলেছে দোকান বরাদ্দপ্রাপ্তরা। স্থানীয়রা জানান, রাতের আঁধারে গাছগুলো কেটে দোকান নির্মাণ করেছে। কাটা গাছের গোড়াগুলো যাতে মানুষের চোখে না পড়ে সেজন্য মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। মাটি খুঁড়লেই গাছের অস্তিত্ব মিলবে।
তাদের অভিযোগ, এমনিতেই টেঙটাইল মোড় এলাকায় বিভিন্ন দলীয় কোন্দল ও কিশোর অপরাধীদের কারণে প্রায় সময় মারামারি-সংঘর্ষ লেগেই থাকে। উৎপাত রয়েছে মাদকসেবীদেরও। ফুটপাত দখল করে এতগুলো দোকান নির্মাণ করা হলে সেখানে লোক সমাগম বাড়বে। বাড়বে অপরাধীদের আনাগোনা আর আড্ডা। অবনতি হবে আইনশৃঙ্খলার।
ফুটপাতে দোকান নির্মাণ না করার দাবি জানিয়ে ইতোমধ্যে টেঙটাইল মহল্লা আওয়ামী লীগের নেতারা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে লিখিত চিঠিও দিয়েছেন। তারা বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির নামে ফুটপাতে দোকান বরাদ্দ নেয়ার পেছনে কিছু ব্যক্তি লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করেছেন। অথচ এসব ফুটপাত দিয়ে গার্মেন্টস ও শিল্প কারখানার হাজারো শ্রমিক চলাফেরা করেন। এ এলাকায় রয়েছে একাধিক গার্মেন্টস ও শিল্প কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানের মালামাল আনা নেয়ার কাজে ভারী যানবাহনও চলাচল করছে এ এলাকা দিয়ে। তারচেয়ে বড় সমস্যা হবে, ফুটপাত ব্যবহার-বঞ্চিত হয়ে পথচারী রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন। শিল্প এলাকা হওয়ায় ভারী গাড়ি চলাচল হয়ে থাকে টেঙটাইল এলাকায়। স্বাভাবিকভাবেই জন চলাচলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হবে।
কয়েকজন কাভার্ডভ্যান ও লরিচালক অভিযোগ করেন, সড়কের পাশে ফুটপাতের উপর দোকানগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়, যাতে গাড়ি মোড় ঘুরানোর সময় কোথাও না কোথাও লেগে যায়। অনেক সময় দোকানের বাইরের মালামাল পড়ে যায়। তখন দোকানদার এবং স্থানীয় বখাটেরা গাড়ি আটকিয়ে চালক-সহকারীকে মারধর করে। প্রশাসনও তাদের কাছে অনেকটা অসহায়।
স্থানীয়রা বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিকরা এসব দোকানের সামনে দিয়ে চলাফেরার সময় প্রতিনিয়ত ইভটিজিংয়ের শিকার হন। এমনকি গার্মেন্টসকর্মীদের সাথে বখাটেরা ধাক্কাধাক্কি পর্যন্ত করে। অসহায় নারী শ্রমিকরা প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রশাসনও এখানে নীরব ভূমিকা পালন করে। সাবেক চসিক প্রশাসকের নির্দেশে বছরখানেক আগে ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করা হলে সবার মাঝে স্বস্তি আসে। কিন্তু খোদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এখন ফুটপাতে দোকান বরাদ্দের খবর শুনে এলাকাবাসী হতবাক।
ফুটপাতে ৩৮ পণ্যের দোকান : টেঙটাইল গেটে যেসব পণ্যের ব্যবসা করা হবে তা হলো, কামার, ব্যাগ, ফ্লেঙিলোড, গ্যাস সিলিন্ডার,কাপড়, ফার্মেসি, টেলিকম, ঘড়ি, চা, ঝাল বিতান, ইলেক্ট্রনিঙ, খাবার হোটেল, হার্ডওয়্যার, বিরিয়ানি, হোমিওপ্যাথিক, জুতা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, লোপ তোষক, বেকারি, কসমেটিঙ, সেলুন, ক্রোকারিজ, হার্ডওয়ার, মুদি দোকান, ফল, দর্জি, পান, মোবাইল, কম্পিউটার, জুয়েলার্স, চুমকি-সুতা, গ্রিল ওয়ার্কসপ, স্ক্র্যাপ, ফার্নিচার শো-রুম, টেলিভিশন মেকানিক, লোহা, ট্যাঙ্ক, সুপারসপসহ নানা পণ্যের দোকান। সেখানে সমিতির একটি অফিস ও গণশৌচাগার থাকবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর টেঙটাইল মোড় এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় সিটি কর্পোরেশন। সেই সময় ফুটপাত হকারমুক্ত করা হয়। ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি উচ্ছেদ করা স্থানে সিটি কর্পোরেশন ফের ফুটপাতে দোকান বরাদ্দের সিদ্ধান্ত দেয়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, উচ্ছেদকৃত টেঙটাইল গেট, শেরশাহ, ও তারা গেট ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রশাসক নিন্মোক্ত সিদ্ধান্ত দেন। সিদ্ধান্তসমূহ হল, চসিকের প্রকৌশল বিভাগ জায়গা চিহ্নিতকরণ, চিহ্নিত জায়গা এস্টেট শাখা থেকে বরাদ্দ দেওয়া হবে। ভাড়া আদায় করা হবে। দোকান মালিকগণ তাদের নিজস্ব খরচে দোকান নির্মাণ করবেন।
সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, টেঙটাইল গেট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির নামে টেঙটাইল মোড় থেকে চন্দ্রনগরমুখী সড়কের দুই পাশের ফুটপাতে ৬৬টি দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। একইভাবে তারা গেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি ও শেরশাহ রোড ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির ব্যানারে শেরশাহ সড়কের দুই পাশের ফুটপাতে ১০০টি, তারা গেট সড়কের দু্‌ই পাশের ফুটপাতে ৯০টি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। ১০/১১ ফুট ফুটপাতের পুরো অংশ জুড়েই গত পাঁচদিনে তড়িঘড়ি করে নির্মাণ করা হয়েছে ৬৬টি পাকা দোকান। টেঙটাইলে ফুটপাতে প্রতি দোকান এক লাখ ৮০ হাজার টাকা করে ৬৬টি দোকান বাবদ এক কোটি ১৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা সেলামি নিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। এছাড়া শেরশাহর ফুটপাতে দোকান প্রতি সাড়ে তিন লাখ টাকা ও তারা গেটে প্রতি দোকান তিন লাখ টাকা করে সেলামি নিয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফুটপাতে কোনভাবেই আর বাণিজ্যিক স্থাপনা নয়
পরবর্তী নিবন্ধআর কী চায় বিএনপি?