গল্পের মতো গল্প

জোনাকী দত্ত | বুধবার , ১৫ মার্চ, ২০২৩ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

আচ্ছা মা, এই পৃথিবীতে সবাই কি নিজের ভাষায় কথা বলে? তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া গল্প তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল। মা হেসে বলল, এ কথা কেন বলছ, গল্প। গল্প বলল, জানো মা ঐদিন ব্যালকনিতে দেখলাম দুইটা চড়ুই মুখোমুখি বসে কিচিরমিচির করছে। তারপর ভোরে যখন দাদুর সাথে বাগানে ফুল তুলতে যাই দেখি নিচে কচি কচি ঘাস, ফুল, ফড়িং মনে হয় যেন ওরা নিজেরা নিজেরা হেলেদুলে অনেক কথা বলছে। তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম। বলো না মা। মা ওকে কাছে বসিয়ে বলল, হ্যাঁ গল্প। আসলে এই পৃথিবীতে সবাই নিজের ভাষায় কথা বলে। যার যার ভাষা সেই বোঝে। তুমি তো জানো, আমরা যে আজ বাংলা ভাষায় কথা বলছি তার জন্য সালাম, রফিক, বরকত আরো কতো নাম না জানা ছেলে বুকের রক্ত দিয়েছিল। মায়ের মুখের ভাষা যারা কেড়ে নিতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। গল্প বলল, হ্যাঁ মা, জানি তো। দাদুর সাথে আমি প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাই। মা বলল, ঠিক আছে। অনেক কথা হলো এবার ঘুমাও। গল্প বলল, কাল তো স্কুল বন্ধ। আর একটু থাকি না মা। মা বলল, না গল্প, বেশি রাত জাগা ভালো নয়। তারপর গল্প বাধ্য ছেলের মতো শুতে গেলো। শুয়ে শুয়ে সে ভাবছে ইস্‌ আমি যদি ফুল, পাখি এদের সাথে গল্প করতে পারতাম! ওরা কোন ভাষায় কথা বলে সেটা যদি বুঝতে পারতাম বেশ মজা হতো। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়লো।

শিশিরের টুপটাপ শব্দে কচি ঘাসগুলো নড়েচড়ে উঠলো। কচি ঘাস বলল, : কি ঠাণ্ডা! দিলে তো ঘুমটা ভাঙিয়ে। শিশির বলল, আর একটু পরেই তো সূর্য মামা ওঠে যাবে। তখন তোমাদের সাথে তো আর খেলতে পারব না। কচি ঘাস আড়মোড়া ভেঙে বলল, তা ঠিক বলেছ শিশির। কিন্তু মনে হয় আজ সূর্য মামা একটু দেরিতে উঠবে। চলো খেলা শুরু করি। শিশির বিন্দু বিন্দু ফোটা ছড়িয়ে দিলো সব কচি কচি ঘাস গুলোর গায়ে। ঘাস, ঘাসফুল হেলেদুলে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। শিশির বলল, আমরা যখন তোমাদের ভিজিয়ে দিই খুব ভালো লাগে। যতোক্ষণ না রোদের সোনালী আলো এসে তোমাদের উষ্ণতায় রাঙিয়ে দেয় ততোক্ষণ আমাদের অস্তিত্ব থাকে। ঘাস বলল, ঠিক বলেছ। আমরাও অপেক্ষায় থাকি প্রতিটি ভোরে। তোমরা আমাদের জাগিয়ে দাও। শিশির বলল, আমরা ক্ষণস্থায়ী । ঐ দেখো, সূর্য উঠছে। এবার চলি বন্ধু। ঘাস বলল, কাল আবার দেখা হবে বন্ধু। বিদায়।

এরপর সূর্যের সোনালী আলো ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে গাছে গাছে ফুলের কলিগুলো ফুটে উঠল। সবাই হাসিমুখে বলাবলি করছে, এখুনি গল্প ওর দাদুর সাথে এসে আমাদের তুলে নেবে। ভ্রমর গুনগুন করে মধু খেতে ফুলের বুকে বসল। ওরা বলল, তোমরা কতো উদার। পরের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েও কেমন হাসিখুশি থাকো। ফুল বলল, আমাদের জীবনের এটাই সার্থকতা। তোমরা মধু খেয়ে তৃপ্তি পাও, মানুষেরা পূজায় বা ঘর সাজাতে আমাদের নিয়ে যায়, এতে আমরা খুব গর্বিত। ভ্রমর বলল, তোমরা উপকারী বন্ধু। ভালো থেকো। এবার আমরা যাই।

কিছুক্ষণ পর পাখিরা কিচিরমিচির শব্দ করে গাছের ডালে এসে বসলো। মা পাখি বাচ্চাদের বলল, তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছি, খেয়ে নাও। বাচ্চারা বলল, খাবার খেয়ে আমরা তোমার সাথে উড়ে ঐ দূরের আকাশ দেখতে যাবো। মা পাখি বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। সে দেখা যাবে।

টুনটুনি গল্পের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, এ্যাই গল্প, তোমার দাদু তো ঐদিকে ফুল তুলতে গেল। তুমি এসো আমাদের সাথে গল্প করবে। গল্প বিরক্ত হয়ে বলল, : তোমরা এতো বেশি কথা বলো, সারাদিন শুধু কিচিরমিচির, কিচিরমিচির। টুনটুনি মুখ গোমড়া করে বলল, , আমরা ছোট বলে তুমি আমাদের বন্ধু ভাবো না। তাই না? গল্প টুনটুনিকে আদর করে বলল, আরে না না। আমি ঐ ফুল , ঘাসফড়িং ওদের সাথে একটু দেখা করে তারপর তোমাদের কাছে এসে গল্প করব। আজ তো আমার স্কুল ছুটি। টুনটুনি খুশি হয়ে বলল, আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে। যাও ।

আজ বাগানে একটি সুন্দর লাল গোলাপ ফুটেছে। সে গল্পকে দেখার সাথে সাথে বলল, আজকে আমায় ছিঁড়ে ফেলো না যেন। আমি দুএকদিন তোমার সাথে আর ভ্রমরের সাথে গল্প করবো। তারপর আমায় নিয়ে যেও। গল্প ফুলটিকে আলতো ভাবে ছুঁয়ে আদর করে দিয়ে বলল, ঠিক আছে বন্ধু। আমি দাদুকে বারণ করে দেবো। এই ঘাসফড়িং কোথায় যাচ্ছ? একটু দাঁড়াও। এতো দৌড়াতে যে আমি পারিনা। বলেই গল্প ঘাসফড়িং এর পিছু নিলো। ঘাসফড়িং বলল, আমরা মধু খেতে যাচ্ছি গো। তুমিও চলো। তোমাকে মধু খাওয়াবো। গল্প বলল, কিন্তু আমাকে যদি দিয়ে দাও তোমাদের তো পেট ভরবে না। ঘাসফড়িং হেসে বলল, তুমি যে আমাদের বন্ধু। চলো, চলো।

প্রজাপতি, প্রজাপতি, তোমাদের এতো তাড়া কিসের? আমি যে তোমাদের সাথে খেলতে এসেছি। তোমরা তো উড়েই চলেছো। গল্প একটা প্রজাপতি হাতে নিয়ে বলল। প্রজাপতি বলল, বা: রে। তোমার দাদু সব ফুল তুলে নেবে। আগে আমরা মধু খেয়ে নি। তারপর খেলব। গল্প হাত থেকে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে যাও। তাড়াতাড়ি এসো। আমি ঘাসের উপর বসে অপেক্ষা করি। কচি কচি ঘাস গুলো বলল, এসো গল্প আমাদের কাছে তুমি বসলে আমরা খুব খুশি হই। গল্প বলল, আমারও ভালো লাগে। তোমরা সবাই খুব ভালো।

এ্যাই গল্প, কী বিড়বিড় করছিস। ওঠ। দাদু ডাকছে। বাগানে যাবি না? ভোর হয়ে গেল যে! গল্প তখনও ঘুমের ঘোরে বলে যাচ্ছে, টুনটুনি আমি এসেছি। তোমাদের সাথে গল্প করতে। মায়ের ডাকাডাকিতে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখানে কেন? আমি তো বাগানে ওদের সাথে কথা বলছিলাম। মা বুঝতে পেরে হেসে বলল, বুঝেছি তুমি স্বপ্ন দেখেছো। চলো চলো। দাদু, তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।