গণমানুষের সেসব গান

| রবিবার , ২৫ জুলাই, ২০২১ at ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাতে মারা যান একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। ফকির আলমগীরের জন্ম ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলার ভাঙা থানার কালামৃধা গ্রামে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফকির আলমগীর জড়িয়ে যান বাম ধারার ছাত্র রাজনীতিতে। সেই সূত্রে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তার গান আর সংগ্রামের জগতে প্রবেশ। ঠিক তার পরপরই এল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়। গানের শিল্পী ফকির আলমগীর তাতেও কণ্ঠ মেলালেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যোগ দিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে ফকির আলমগীর বলেছিলেন, সাতই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনেই তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন।
ফকির আলমগীরের বয়স তখন ২১ বছর। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে কলকাতার নারিকেল ডাঙায় শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠীতে যোগ দেন তিনি। সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত এম এ মান্নান ছিলেন সেই সংগঠনের দলনেতা। সেখানে ফকির আলমগীরের সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন তিমির নন্দী, নাট্যকার-অভিনেতা মামুনুর রশীদসহ আরও অনেকে।
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে দেশজ সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা পপ গানের বিকাশে মাতেন তরুণ শিল্পীদের একটি দল। আজম খান, ফিরোজ সাঁই আর ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে ফকির আলমগীরও তখন পপ গানে উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন শ্রোতাদের মাঝে।
ফকির আলমগীরের গণমানুষের শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল যে গানের চরিত্রের, তার নাম সখিনা। ১৯৮২ সালে বিটিভিতে ঈদের আনন্দমেলায় ‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে’ গানটি প্রচারের পর দর্শকদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। গানটি লিখেছেন আলতাফ আলী হাসু। কণ্ঠ দেয়ার পাশাপাশি ফকির আলমগীর গানটির সুরও করেছিলেন। ২০১৬ সালে ফকির আলমগীর এক নিবন্ধে তার সেই সখিনার গল্প বলেছেন সবিস্তারে। তিনি লেখেন, ‘সখিনা আবহমান বাংলার প্রেমিকা ও বধূ। কারও কাছে দুঃখিনী পল্লীবালা আবার কারও কাছে আহ্লাদী বোন। কারও কাছে সে বন্যায় ভেসে যাওয়া বিক্ষুব্ধ চিৎকার। এই সখিনা কখনো রিকশাওয়ালার প্রিয়তমা স্ত্রী। কখনও কারখানার শ্রমজীবী নারী, কখনও বা ফুটপাতের ইটভাঙা শ্রমিক।’ নব্বইয়ে সামরিক শাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনে প্রতিবাদী গানে ফকির আলমগীরের সরব উপস্থিতি তাকে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তার নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। তবে তার আগেই মাকে নিয়ে লেখা তার আরেকটি গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘মায়ের একধার দুধের দাম’ গানটি সিনেমাতেও ব্যবহৃত হয়েছিল।
২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে ফকির আলমগীর বলেছিলেন সেই গানের পেছনের গল্প। ১৯৭৭ সালে মাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গাড়িতে যাচ্ছিলেন ফরিদপুরে। আরিচা ঘাটে এক অন্ধ বাউলের কণ্ঠে প্রথম তিনি ওই গান শোনেন। তিনি এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন, যে ঢাকায় ফিরে নিজের মত করে গানটি তৈরি করেন। পরে বিটিভির এক অনুষ্ঠানে সেটি পরিবেশিত হয়। ‘মন আমার দেহ ঘড়ি’, ‘আহারে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ও জুলেখা’, ‘ঘর করলাম না রে আমি’, ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’, ‘বনমালী তুমি’সহ তার গাওয়া বহু গান আশি ও নব্বইয়ের দশকে দারুণ জনপ্রিয় ছিল।
নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন উপলক্ষে গাওয়া একটি গান ছিল ফকির আলমগীরের নিজের কাছেই প্রিয়। ১৯৯৭ সালের মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নেলসন ম্যান্ডেলা যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, সে সময় তাকে নিয়ে লেখা সেই ‘কালো কালো মানুষের দেশে’ গানটি শুনিয়েছিলেন ফকির আলমগীর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণসংগীতের জায়গাটা শূন্য হয়ে গেল
পরবর্তী নিবন্ধতাঁর কণ্ঠে মুখরিত হবে না আর এই প্রান্তর