ক্ষমা করো রাসেল

রেজাউল করিম | বুধবার , ১৮ অক্টোবর, ২০২৩ at ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ প্রযোজনায় বিখ্যাত পরিচালক শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘মুজিবএকটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্র গত ১৩ অক্টোবর সারাদেশে মুক্তি পেয়েছে। ছবিতে শেখ রাসেলের দূরন্তপনা যে কারো মনে রেখাপাত করেছে। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে তার জন্ম। ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ বইয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন -‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।’

বঙ্গবন্ধু চাইতেন তার সন্তান মুক্তমনা ও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনায় মানুষ হয়ে উঠুক। ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন তার প্রিয় দার্শনিক। তাই আদরের সন্তানের নামকরণও করেন প্রিয় দার্শনিকের নামে। বঙ্গবন্ধু চাইতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের উদার, মানবতাবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক চেতনায় প্রভাবিত হোক শেখ রাসেল। বার্ট্রান্ড রাসেলের দার্শনিকতা অল্প বয়সে শিশু রাসেল অনেকটা রপ্ত করেছিলেন। যা ‘মুজিবএকটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রে দেখা যায়।

রাসেলের জন্মের বছরই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইন্তেকাল করেন। আওয়ামী লীগের হাল ধরেন তিনি। ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল আওয়ামী লীগ গড়ে তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৬৪ সালে আবার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ভোটের ২ সপ্তাহ আগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ফলে জন্মের পরের শৈশবে সেভাবে বাবাকে কাছে পাননি শেখ রাসেল।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কারাগারে বন্দি বাবাকে দেখতে গেলে তাকে রেখে ফিরে আসতে চাইতেন না। ফিরলেও মন খারাপ করে থাকতেন। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে লিখেছেন

১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে নাযে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম।

একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’।

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। তখন রাসেলের বয়স ৪ বছর। ওই সময়টাতে শিশু রাসেল প্রথম পিতাকে তার কাছে পেলেন। পিতার সঙ্গেই দিনরাত কাটে তার।

বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতেন রাসেল। কিন্তু বাবাকে যে বেশিক্ষণ কাছে পেতেন না। বাবার কত্ত কাজ। বেশিরভাগ সময়ই বাবা থাকতেন জেলে। তবে রাসেলের ভীষণ প্রিয় ছিলেন হাসুপা। মানে শেখ হাসিনা। হাসুপার চুলের বেণি ধরে খেলতেন। হাসুপার হাত ধরেই হাঁটা শিখেছিলেন।

রাসেলের চার বছর বয়সে বাবা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। এর মাঝে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলো বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। অবশেষে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পেলেন জাতির পিতা। মুক্তির পর বাবাকে আর চোখের আড়াল হতেই দিতে চাইনে না রাসেল।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করল আওয়ামী লীগ। এলো মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে নিয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানে। আর পরিবারের বাকিদের বন্দি করে রাখল একটা একতলা বাসায়। বড়দের সঙ্গে ছোট্ট রাসেলেরও বন্দিজীবন শুরু হয়েছিল। ঠিকমতো খাবার নেই, খেলনা নেই। বই নেই।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু রাসেলদের মুক্তি হলো ১৭ ডিসেম্বর সকালে।

বঙ্গবন্ধু বীরদর্পে ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। আবেগে আপ্লুত রাসেলের সাথে বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধুর বিদেশ সফরে গেলে সাথে রাসেলকে প্রায় নিয়ে যেতেন। ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই। সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিল রাসেলের। হাসুপা আর আপু (শেখ রেহানা) চলে গেছেন জার্মানিতে। সঙ্গে নিয়ে গেছেন খেলার সঙ্গী হাসুপার ছেলে জয়কেও। হাসুপার সঙ্গে রাসেলও যেতে চেয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ঘাতকদের নির্মম বুলেট রক্ষা পাননি শিশু রাসেলও। এই ঘাতকদের কাছেই সেদিন করুণ মিনতি করেছিলেন ছোট্ট রাসেল-‘আমি মায়ের কাছে যাব।’

নিষ্পাপ রাসেলের করুণ মিনতিতে সেদিন ঘাতকদের হৃদয় ভিজেনি। রাসেলকে সেদিন ঘাতকরা মায়ের কাছেই পাঠিয়েছিল বড় নির্মমভাবে। ‘রাসেল, অবোধ শিশু, তোর জন্যে/ আমিও কেঁদেছি/ খোকা, তোর মরহুম পিতার নামে যারা/

একদিন তুলেছিল আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি/ তারাই দুদিন বাদে থুথু দেয়, আগুন ছড়ায়/ বয়স্করা এমনি উন্মাদ/ তুই তো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে/ সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি/ তবু পৃথিবী আজ এমন পিশাচী হলো/ শিশু রক্তপানে গ্লানি নেই/ সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে/ যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়/

আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই।’ (‘শিশু রক্ত’সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়তে হলে শিশুদেরও গড়তে হবে। তাদের ভেতরে জাগাতে হবে দেশপ্রেম। ঘাতকের বুলেট সেই স্বপ্ন চুরমার দেয়। শৈশবে যদি দেশপ্রেম ও সঠিক ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যায়, বাংলাদেশ কখনও পথ হারাবে না। রাসেলের পথ বেয়ে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসবার প্রিয় রাসেল
পরবর্তী নিবন্ধঘাসফুল পরাণ রহমান স্কুলে শিক্ষার্থীদের চক্ষু পরীক্ষা