কীর্তিমান আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

ছন্দা দাশ | শুক্রবার , ২ অক্টোবর, ২০২০ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

আমাদের পূর্ব পুরুষের প্রচুর সাহিত্য সম্পদ ভূগর্ভে প্রোথিত হইয়া গিয়াছিল। সে সকল রত্ন আমি ভূগর্ভ হইতে উৎখাত করিয়া মানুষের লোকলোচনে গোচুরীভূত করিয়াছি মাত্র। তার জন্য অনেকে আমাকে পুঁথি সংগ্রাহক মাত্র মনে করে। আমি নিজেও নিজেকে ততোধিক কিছু মনে করি না।’ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

যদি প্রশ্ন করা হয় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ কে? আমাদের মতো অনেক সাহিত্য প্রেমিকই নীরব থাকবেন জানি। অবশ্য বাংলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা পড়েছেন তাঁদের কথা আলাদা। আবার তাঁদের মধ্যেও অনেকেই তাঁকে কেবল পুঁথি সংগ্রাহক হিসেবেই আখ্যায়িত করে থাকেন। সত্যিই কি তাই? আমরা যদি তাঁর সমস্ত জীবনের দিকে আলোকপাত করি তবে দেখতে পাই বাংলার ইতিহাসঐতিহ্য অন্বেষার তিনি প্রাজ্ঞ পুরুষ। এজন্যই তাঁর নামের শেষে যুক্ত হয়েছে সাহিত্যবিশারদ শব্দটি। বিশারদ শব্দের আভিধানিক অর্থ পারদর্শী অর্থাৎ পণ্ডিত যে জন। বাঙালি, বাংলা সাহিত্য এই বিশেষ মানুষটির কাছে চিরঋণী। তাঁর অদম্য মনোবল আর ত্যাগের ফলে সহস্রাধিক লুপ্তপ্রায় পুঁথি উদ্ধার হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ ও ত্বরান্বিত। তাঁর সংগৃহীত পুঁথির সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। সতের শতকের কবি আলাওলের পদ্মাবতী ও অন্যান্য কাব্যের পুঁথি উদ্ধার, পুঁথি পরিচিতিসহ তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণা তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান বাংলা সাহিত্যে। বলা যেতে পারে তাঁর শ্রেষ্ঠ গবেষণা মহাকবি আলাওল ও তাঁর অমর কীর্তি পদ্মাবতী যা হীরক খণ্ডের মতই জাজ্বল্যমান। তিনি তাঁর দীর্ঘ ৮৩ বছরের জীবনের মধ্যে ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলার প্রাচীন বিলুপ্ত, দুর্লভ ও অজ্ঞাত পুঁথি সংগ্রহ, সম্পাদনা ও তার ভিত্তিতে মধ্যযুগের কবি ও কাব্য সম্পর্কে দীর্ঘ ভূমিকাসহ আলোচনা ও বিশেষণ দ্বারা বাংলা সাহিত্যকে পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছিলেন। তাঁর এই অসামান্য পুঁথি সংগ্রহের ফলে প্রায় দেড় শতাধিক অজানা ও নতুন কবির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। মধ্যযুগের হিন্দুমুসলমান সাহিত্য সাধকদের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে তিনি তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন। তিনি যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তা সংগ্রহ না করতেন তাহলে আজ হয়তো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। ইউরোপীয় সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতালব্ধ নান্দনিকতার রুচিগত অবস্থান থেকে বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যিকরা বাংলা পুঁথিসাহিত্যকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না। সম্ভবত সেই কারণেই আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদও যথাযথ গুরুত্ব লাভ করেননি। অথচ তাঁর বিশাল অবদানের জন্য তাঁকে যতটা চেনার কথা ততটা চেনা কিনু্ত হয়ে ওঠেনি। শুধু ব্যতিক্রমী দু’একজনের বিচার ও উপলব্ধির প্রকাশ থেকেই আমরা জানতে পারি বাঙালির সাহিত্য ইতিহাস ও জাতীয়তাবোধে কী ভূমিকা রেখেছে তাঁর এইসব পুঁথির বিপুল সংগ্রহ। আবদুল করিম সংকলিত বাঙালা পুঁথির বিবরণ বইয়ের নিবেদনঅংশে শ্রী ব্যোমকেশ মুস্তফি লিখেছেন পুঁথি সংগ্রহ করতে কী কষ্ট, অপমানই না স্বীকার করতে হয়েছিল তাঁকে। গভীর অন্তর্দৃষ্টি না থাকলে কার অন্তরে জাগে পুঁথির অতলে ডুব দেবার এমন তীব্র আকাঙ্ক্ষা!

পুঁথি সংগ্রহের জন্য তিনি গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ছিল না তাঁর আর্থিক সঙ্গতি, ছিল না পুঁথি কিনবার মতো অর্থ। ছিল শুধু পুঁথি সংগ্রহের নেশা আর ভালোবাসা।এর জন্য দিতে হয়েছে তাঁকে জীবনের অমূল্য সময়, সয়েছেন মানুষের উৎপীড়ন, অপমান। ভিখিরির মতো মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতেছেন। কোন মুসলমান, কোন হিন্দুর ঘরে প্রবেশের অধিকার তাঁর নাই। হিন্দুর ঘরে পুঁথি ছুঁয়ে দেখার অনুমতি তাঁর নাই। কেউ দয়াপরবশ হয়ে পুঁথি খুলে দেখালে না ছুঁইয়ে শুধু চোখ দিয়ে পড়ে তাঁকে নোট করে নিতে হয়েছে।

তিনি যখন একের পর এক পুঁথির পাঠোদ্ধার করতে থাকলেন তখনই অনুভব করলেন এগুলোর প্রকাশনার গুরুত্বের কথা।

অক্ষয় চন্দ্র সরকার সম্পাদিত পূর্ণিমাপত্রিকার ১৮৯৬ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় তিনি লেখেন ‘অপ্রকাশিত প্রাচীন পদাবলী’। এ দিয়েই বলতে গেলে শুরু সারস্বত সমাজ অভিমুখে তাঁর যাত্রা। তাঁর সম্পাদিত ও রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্য রাধিকার মানভঙ্গ‘, ‘সত্যনারায়ণের পুঁথি, মৃগলুদ্ধ, গোরক্ষবিজয়, পদ্মাবতী (খণ্ডাংশ) ও অন্যান্য। তাঁর সঙ্কলিত ও রচিত গ্রন্থ’ বাঙ্গালা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ ১ম সংখ্যা (১৩২১ব) পুঁথি পরিচিতি (আহমদ শরীফ সম্পাদিত, বাংলা বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯৫৮)ইসলামাবাদ(সৈয়দ মুর্তজা আলী সম্পাদিত ১৯৬৪)ও আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য (মুহাম্মদ এনামুল হকের সহযোগিতায়)

পদ্মাবতী অর্থাভাবে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারেননি। সতীময়না, লোরচন্দ্রানী প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশের তাঁর খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা আর তাঁর সম্ভব হয়নি। এই দুঃখ নিয়ে তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। সাহিত্য প্রেমিক এই মানুষের উদাহরণ আজ অবধি অন্যকোন কেউ সেই ইতিহাস ভঙ্গ করতে পারেনি। মৃত্যুশয্যায়ও এই সাহিত্য বিশারদ সাহিত্যের অমর উদাহরণ দিয়ে গেছেন। মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ যখন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মাটিতে ঢলে পড়েছিলেন তখনও তাঁর হাতে ছিল লেখনী।

তিনি প্রায় ছয় শতাধিক পুঁথির পরিচয়মূলক প্রবন্ধ লিখে গেছেন। তাঁর সম্পাদনার মান কতটা উঁচু ছিল সে সম্পর্কে আমরা ডঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখায় জানতে পারি। তিনি লিখেছেন, শ্রী আবদুল করিম চট্টগ্রামের একটি বাঙালা বিদ্যালয়ের পণ্ডিত। তাঁহার সাংসারিক অবস্থা ভালো নহে। তথাপি তিনি সাহিত্য সেবায় অকাতর পরিশ্রম করিয়া থাকেন।বাংলা সাহিত্যের প্রতি এই অনুরাগের প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না।এই দুর্লভ গ্রন্থে’র সম্পাদনা কার্যে যেরূপ পরিশ্রম, যে রূপকৌশল, যে সহৃদয়তা ও যে সূক্ষ্ম দর্শন প্রদর্শন করিয়াছেন তাহা সমস্ত ভারতেও বোধহয় মেলে না।

ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হক তাঁর ঋণ স্বীকার করে বলেছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সাহেবের (১৮৬১১৯৫৩) আবির্ভাব না ঘটিলে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইতাম।

একথা অনস্বীকার্য যে তাঁর সংগৃহীত গ্রন্থ’ ছাড়া বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচিত হতে পারে না।

১৯০৯ সালে চট্টল ধর্মমণ্ডলী তাঁকে সাহিত্যে অসামান্য কীর্তির জন্য ‘সাহিত্য বিশারদ’ ও ১৯০২ সালে নদীয়ার সাহিত্য সভা তাঁকে সাহিত্য সাগরউপাধিতে ভূষিত করেন। গবেষণা কর্মে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করেন। বাংলা সাহিত্যের এই প্রাজ্ঞ পুরুষ চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে ১৮৬১ সালের ১১ই অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মুন্সী নুরুউদ্দীন। মায়ের নাম মিশ্রিজান। বাবার মৃত্যুর তিন মাস পর তাঁর জন্ম হয়।

১৮৯৩ সালে তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৯৫ সাল অবধি ওই অঞ্চলের একমাত্র এফ, (পাস্ট আর্টস, এখনকার এইচ,এস,সির সমতুল্য) পড়ুয়া ছাত্র ছিলেন। আবদুল করিম ১৮৯৬৯৭ সালে জজ আদালতে এ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে এবং ১৮৯৮ সালে কমিশনার অফিসে ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৯৯১৯০৫ সাল পর্যন্ত তিনি আনোয়ারা মধ্য ইংরেজী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।এরপর ১৯০৬ ৩৪ সাল পর্যন্ত বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টর অফিসের কর্মচারী ছিলেন। অবসর জীবনেও আবদুল করিম সাহিত্যসেবা ছাড়াও জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং পটিয়া আঞ্চলিক ঋণ সালিশি বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আজীবন সাহিত্য অনুরাগী এই সাধক মানব বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ সভাপতি (১৯১৯), কলকাতা মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি(১৯৩৯), চট্টগ্রাম সংস্কৃতি সম্মেলনের সভাপতি(১৯৫২) ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স ও বি,এ পরীক্ষার বাংলার পরীক্ষক এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্সের প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষক ছিলেন। এতকিছু করবার পরেও এই মহান সাহিত্য প্রেমিক বলতেন, “বঙ্গ সাহিত্যের জন্য আমি এমন কিছু করি নাই যাহা লইয়া আমি গর্ব করিতে পারি। তিনি আরও বলতেন, ‘ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগই সংস্কৃতি সাধনার আসল সোপান’। চট্টগ্রামের ক্ষণজন্মা এই কৃতীপুরুষ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য বড় অহংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিরকুটের সংখ্যাগুলো
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা