ডিসি মহোদয়, ডিসি হিল নিয়ে আরেকটু ভাববেন
গত কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে চমৎকার একটি সন্ধ্যা কাটালাম। সার্কিট হাউজে অনেকবার গেছি কিন্তু সেদিনের সন্ধ্যাটি ছিল অন্যরকম।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের আগ্রহ ও উদ্যোগে এবছর স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আর্টপেপারে সম্পূর্ণ চাররঙা বর্ণাঢ্য, সমৃদ্ধ ও সুসম্পাদিত ‘বিজয় নিশান‘ নামে একটি সংকলন বের হয়েছে। সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আব্দুল মালেক যিনি কবি হিসেবে মালেক মুস্তাকিম নামে পরিচিত। সংকলনে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় লেখকদের মধ্যে প্রায় সবার লেখা ছাপা হয়েছে। সেদিন সন্ধ্যায় লেখকদের সঙ্গে চা–চক্রে মিলিত হয়েছিলেন জেলা প্রশাসকসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ।
অনুষ্ঠানে প্রায় লেখকেরাই তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। ফখরুজ্জামান সাহেব নিজেও অনেক কথা বলেছেন খোলামেলাভাবে। অনুষ্ঠানে সব লেখকের হাতে সৌজন্য সংখ্যা তুলে দেওয়ার সঙ্গে লেখার সম্মানীও দেওয়া হয়েছে। সরকারি পর্যায় থেকে এর আগে লেখকদের এমন সম্মান ও সৌজন্যতা প্রদর্শন করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
চট্টগ্রামবাসী মাত্রই জানেন আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করে অনেক গঠনমূলক কাজ করে ফেলেছেন। যে কারণে তিনি সর্বমহল থেকে প্রশংসিত হয়েছেন। আউটার স্টেডিয়ামকে তিনি একেবারেই বদলে দিয়েছেন। বর্তমানে কার্পেটের মতো সবুজ ঘাস দেখে বোঝার উপায় নেই যে, পরিত্যক্ত হয়ে এই মাঠটি ট্রাক স্ট্যান্ড আর শৌচাগারে পরিণত হয়েছিল। তার চারপাশ অবৈধ দখলে স্বকীয়তা হারিয়েছিল। তিনি প্রভাবশালী অবৈধ দখলদার হাত থেকে আউটার স্টেডিয়ামটিকে বাঁচিয়েছেন।
তিনি ভাটিয়ারিতে দখল হয়ে থাকা সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার করে ফুলের উদ্যান বানিয়েছেন। টিকেট কেটে মানুষ সেখানে হরেকরকম ফুল দেখতে যায়।
বৈঠকে বিভিন্নজন তাদের মতামত প্রদান করেছেন। আমার বক্তব্যে আমি সার্কিট হাউজকে (পুরনো) মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর করার অনুরোধ করেছিলাম যেহেতু সে ভবনটির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি জড়িত আছে। আর সে সঙ্গে সমপ্রতি উচ্ছেদ হওয়া শিশুপার্কের জায়গাটি উন্মুক্ত রাখার দাবি জানিয়েছিলাম। তিনি আমার দাবির প্রতি সহমত পোষণ করায় স্বাভাবিকভাবে আমি উৎসাহিত হয়েছি, প্রাণিত হয়েছি। বুঝতে পারলাম তিনি পরিবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন তাই পরিবেশসহায়ক অনেক কাজ করতে চান। তিনি ডিসি হিল নিয়েও অনেক ইতিবাচক কথা বলেছেন। পরিবেশবান্ধব বৃক্ষরোপণের ওপর জোর দিয়ে পরিবেশের ক্ষতিকর গাছ রোপণ না করার অনুরোধ করছেন। আগেও উল্লেখ করেছি, আমি তাঁর কথায় প্রাণিত হয়েছি। তাই নিম্নে কিছু সুপারিশ তুলে ধরছি তাঁর সুবিবেচনা প্রত্যাশা করে।
চট্টগ্রামের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পীঠস্থান ছিল ডিসি হিল বা নজরুল স্কয়ার। প্রায় বছরব্যাপী এখানে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, উৎসব ও বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। এছাড়া সকাল– সন্ধ্যায় নানান বয়েসি মানুষ এখানে হাঁটতে ও অবসর সময় কাটাতে আসেন।
একটি সময় ছিল যখন এই পাহাড় বিভিন্ন বড় বড় বৃক্ষরাজীতে পরিপূর্ণ ছিল। বিশাল বিশাল শিশু গাছের শেকড়ে বসে মানুষ আড্ডা দিতো। ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু হওয়া নববর্ষের অনুষ্ঠান হতো এসব গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে, ছায়ায় ছায়ায়। এই পাহাড়ের পাশ দিয়ে আসতে যেতে হঠাৎ কখনো পলাশ বা শিমুল গাছের ফুল দেখে বোধ হয়েছে এখনতো বসন্তকাল। আমাদের কৈশোর–তারুণ্যে এত এত মিডিয়া টিভি বা পত্রিকা ছিল না। অনেক ঘটা করে আড়ম্বর করে বসন্ত উৎসবও পালিত হতো না। ডিসি হিলের পলাশ ফুল দেখে আর তার ডালে বসা কোকিলের কুহুতান শুনে বুঝতে পারতাম ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’।
এক সময় চট্টগ্রাম শহরেই অনেক পাহাড় ছিল। বর্তমান ডিসি হিলটি এই এলাকার কয়েকটি পাহাড়ের মধ্যে একটি। আন্দরকিল্লা নজির আহমদ সড়কের পশ্চিমে, মোমিন রোডের দক্ষিণ–পূর্ব, বৌদ্ধ মন্দিরের পূর্ব ও সিনেমা প্যালেসের উত্তর অংশ জুড়ে কয়েকটি পাহাড়। ১) ফরেস্ট হিল, ২) তুলসী ধাম, যা কাটার পর একদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও টেলিগ্রাফের টাওয়ার, ৩) কমিশনারের পাহাড় ও ৪) জাফর আলী হিল বা বর্তমানের ডিসি হিল। ইতিহাস বিবৃত করলে পাঠকদের সুবিধা হবে বুঝতে তাই একটু পেছনে ফিরে যেতে চাই। ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে ইংরেজ শাসকরা পার্বত্যবাসীদের খুশি করতে তৎকালীন চাকমা রাজাকে এই চারটি পাহাড়ের মালিকানা প্রদান করে। পরবর্তীতে আঠারো শতকের শেষ দশকে ইংরেজ সরকার চাকমা রাজাদের কাছ থেকে ওর বেশির ভাগ অংশ পওনি হিসেবে নেয়। দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার বর্তমান এই পাহাড়গুলো হুকুম দখল করে। তবে ডিসি হিলের পূর্ব দিকে চাকমা রাজাদের সম্পত্তি এখনও আছে। তাদের একটি দীঘি ছিল যার নাম ছিল রাজাপুকুর। এখন পুকুর নেই রাস্তার নাম রয়ে গেছে রাজাপুকুর লেইন। বর্তমান ডিসি হিল এক সময় জাফর আলী হিল নামে খ্যাত ছিল। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে এটি তৎকালীন সরকারি উকিল বাঁশখালীর জাফর আলী খানের বাসভবন ছিল। পরবর্তীকালে সাব জজ এবং জাফর আলী খানের সন্তান আনোয়ার আলী সেখানে বসবাস করতেন। এখানেই আনোয়ার সাহেবের পুত্র দার্শনিক ও চিন্তাবিদ শাহ মোহাম্মদ বদিউল আলম জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে এখানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলো স্থাপিত হয়। ওই পদ বিলুপ্ত হলে ডিসি বা জেলা প্রশাসকরা বর্তমানে এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত বাংলোতে বসবাস করে আসছেন।
বর্তমানে ডিসি হিলে একটি মুক্ত মঞ্চ ও দর্শক গ্যালারি আছে। কয়েকবছর ধরে সেখানে কোনো অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয় না। অনুষ্ঠানে কয়েকজন বক্তার অনুরোধের জবাবে তিনি সেখানে অনুষ্ঠান করার বিষয়ে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন।
ডিসি হিলে কিছু নার্সারি ও ফুলের দোকান আছে। আর সে সাথে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু গাছপালা যা শতবর্ষী শিশু গাছগুলোসহ প্রকৃতির ক্ষতি সাধন করছে। জেলা প্রশাসক মহোদয় বরাবর এবার আমি আমার প্রস্তাবনাটুকু উপস্থাপন করছি।
১। এই পাহাড়ের সকল নার্সারি ও ফুলের দোকান এবং সে সাথে সকল অবৈধ দখলদারিদের উচ্ছেদ করা।
২। সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর গাছ কেটে পুরো পাহাড়জুড়ে দেশীয় ফলের গাছ রোপণ করা । কাজটি একসঙ্গে না করে পর্যায়ক্রমে করতে হবে। আমাদের সন্তানরা বেশিরভাগ দেশীয় ফল চেনে না, গাছ দেখা তো দূরের কথা। গাছের ফাঁকে ফাঁকে সারা পাহাড় জুড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে দিলে সবাই ঘুরে ঘুরে গাছ দেখবে, চিনবে, ফলের সঙ্গে পরিচিতি ঘটবে। এর মধ্যে কয়েকটি ছাউনি নির্মাণ করে দিলে রোদ ও বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সেখানে আশ্রয় নেওয়া যাবে। ফলের বাগান হলে সেখানে আপনা থেকেই পাখি আসবে। গড়ে উঠবে পাখিদের অভয়াশ্রম। এর মধ্যে কিছু মনুষ্যবান্ধব পশু যেমন খরগোস, বানর ইত্যাদি ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
এই ফলের বাগান থেকে হয়ত আর্থিক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে গাছ, ফুল, ফল চেনাতে ও মৃত্তিকা সংলগ্ন করতে বিশাল ভূমিকা রাখবে। এই পাহাড়ে আর একটিও স্থাপনা চাই না। আর এক ইঞ্চিও ইট–চুন–সুরকীর প্রলেপ চাই না। এই পাহাড় তার সবুজ নিয়ে অক্ষত থাকুক।
পাশে আগে যেখানে একটি পুকুর ছিল বর্তমানে যা ভরাট করে নার্সারি ব্যবসায়ীদের লিজ দেওয়া হয়েছে, সেখানে শিশুদের সাঁতার শেখার জন্য একটি সুইমিং পুল নির্মাণ করা যেতে পারে।
৩। এই বিরাট নগরীজুড়ে শুধু ইট–সিমেন্টের অট্টালিকা। কোথাও একটু খোলা ময়দান নেই। আমাদের চট্টগ্রামে কোনো ‘রমনা পার্ক’ নেই, ‘সোহরাওয়ার্দী’ ও ‘ওসমানী উদ্যান’ নেই, আমাদের জাতীয় উদ্যান নেই। ‘ধানমন্ডি লেক‘, ‘গুলশান লেক‘, ‘হাতিরঝিল‘ নেই।
তেমন কোনো খোলা মাঠ নেই, সরোবর নেই, নয়ন জুড়ানো একটু সবুজ নেই। এই বিস্তৃত–বিস্তীর্ণ শহরে একটু খোলা মাটি নেই যে মাটি একটু বৃষ্টির জল শোষণ করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে সমৃদ্ধ করতে পারে। আমাদের সন্তানদের জন্য অন্তত এই ডিসি হিলকে উন্মুক্ত রাখুন– যেখানে জল–কাদা মাখামাখি করতে পারে তারা। হাজারো ভেজালের ভিড়ে এখনও এখানে ভোরে ও সন্ধ্যায় শত শত স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ আসে একটু খোলা নিশ্বাস নিতে এই ব্যবস্থাটি রুদ্ধ ও বাধাগ্রস্ত করবেন না দয়া করে। এই নগরীর হৃদপিণ্ড এই ডিসি হিলকে সবুজে সবুজময় করুন। এর জন্য খুব বেশি ব্যয়ের প্রয়োজন নেই। মাত্র কয়েক লাখ টাকায় পুরো পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন সম্ভব।
৪। দখলে–দূষণে চট্টগ্রাম দিন দিন বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এই শহরের হাজার হাজার দীঘি–পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে। পাহাড় কেটে কেটে চট্টগ্রামের ভৌগোলিক বিশেষত্ব খর্ব করা হয়েছে। নদী–খাল দখলে–দুষণে–তার গতিপথ হারিয়েছে। আমরা আমাদের সন্তানদের কী বিভীষিকাময় ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এর দায় থেকে আমরা কেউই রক্ষা পাব না। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম শীর্ষে। উন্নত বিশ্বের পাপের দায় নিতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে। এই অবস্থায় আমাদের সকল উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষার দিকে নজর দিতে হবে প্রথমে।
জেলা প্রশাসকের সেদিনের বক্তব্যে পরিবেশ নিয়ে তাঁর উদ্বিগ্নতার আভাস পেলাম। ডিসি হিলে অনেক অনেক ধরনের গাছ আছে যা পরিবেশবান্ধব নয়, তিনি যে সে বিষয়ে সজাগ তার বার্তা পেলাম।
২০০৬ সালে একটি নাগরিক মতবিনিময় সভায় আমি প্রথম এমন একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলাম। তারপর কয়েকবার এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে পত্রিকায় লিখেও ছিলাম। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেননি।
তাঁর বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার কারণে চট্টগ্রামের প্রতি তাঁর আলাদা টান আছে। তাঁর কাজে সে কথার যেন আরও প্রতিফলন দেখতে পাই।
লেখক : কবি–সাংবাদিক