কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৮ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:১০ পূর্বাহ্ণ

ধর্ষণের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল দরকার
ধর্ষণের মতো অপরাধকে নারীর সম্ভ্রমহানি বলে যা বোঝাতে চাই তা কি যথার্থ? নারীর সম্ভ্রমহানি বললেও প্রকৃতপক্ষে এই সম্ভ্রমহানি মানুষের, সমাজের, রাষ্ট্রের তথা মানবজাতির। ফলে একজন নারীর সম্ভ্রম হারালো তো মানবজাতিই সম্ভ্রম হারালো, মানবতা সম্ভ্রম হারালো। যারা নারীর সম্ভ্রম কেড়ে নেয় তারা পক্ষান্তরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করে। কাজেই এদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগও আনতে পারে রাষ্ট্র পক্ষান্তরে সরকার।
একটি জাতি বা রাষ্ট্র কতটুকু সভ্য তা নির্ণিত হয় সে জাতি বা রাষ্ট্র তার শিশু ও নারীর প্রতি কেমন আচরণ করে এবং তারা কতটা নিরাপদ তার ওপর। যদিও বিশ্বের কোনো দেশ বা সমাজে নারীরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় তবুও বলতে হয় সভ্য দেশগুলো ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় সেখানে ধর্ষণকারীকে বিচারের আওতায় আসতে হয় এবং দ্রুত শাস্তি পেতে হয়।
একটি সমাজে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অপরাধীর বিচার না হওয়া বা বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়া। আমরা তো জানি জাস্টিস ডিলে জাস্টিস ডিনাই। দেরিতে বিচার হওয়া বিচার না হওয়ারই নামান্তর। এক্ষেত্রে বিখ্যাত লেখক ঙৎংড়হ ডবষষবং এর বিখ্যাত উক্তিও স্মরণ করতে পারি। তিনি বলেছিলেন, ‘ ঘড় ড়হব মবঃং ঔঁংঃরপব, অষষ ুড়ঁ মবঃ রং মড়ড়ফ ষঁপশ ড়ৎ নবফ ষঁপশ.’
অন্য অপরাধগুলোর সঙ্গে ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো বিচার না হওয়া বা বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। ধর্ষণপরবর্তী পরিস্থিতি কাটিয়ে থানায় অভিযোগ করা থেকে শুরু করে মামলার রায় পর্যন্ত যেতে একজন ধর্ষিত নারী এবং তার পরিবারকে কী বিরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। আমাদের সমাজের অধিকাংশের চোখ একজন ধর্ষিতাকে অপরাধী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। যে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নারীকেই অপরাধী বা ধর্ষণের জন্য দায়ী করার চেষ্টা করা হয়। আর ভিকটিমকে সমাজে অচ্ছুৎ, একঘরে করার চেষ্টা চলে।
এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত নারীর পক্ষে কিংবা নিরপেক্ষ না থেকে অপরাধীর পক্ষে থাকে। থাকার কারণ হলো এমন ঘটনায় দোষীদের ভয় দেখিয়ে এবং মামলা থেকে রক্ষা করার প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। আরেকটি বিষয় দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এমন ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে না থেকে দোষীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন।
এ প্রসঙ্গে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার একলাশপুরের ঘটনাটি উল্লেখ করি। এই গ্রামে ২ সেপ্টেম্বর রাতে ১৪/১৫ জন যুবকের একটি দল দরজা ভেঙে ঢুকে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালায়। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ৩২ দিন পর পুলিশ তৎপর হয়। সিলেটের এমসি কলেজের নারী নির্যাতনের ঘটনার রেশ শেষ হতে না হতেই একলাশপুরের ঘটনাটি দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে।
এ ঘটনার কিছুদিক আমাকে হতাশ করেছে। নিজঘরে থাকা একজন নারীকে এভাবে অপমান করল কিছু যুবক আর এই ঘটনা জেনেও পাড়া ও গ্রামবাসী এতদিন নিশ্চুপ ও প্রতিবাদহীন থাকলো কী করে? সে গ্রামে কি দুয়েকজন প্রতিবাদী যুবক বা মানুষ ছিল না যারা নিজে প্রতিবাদ করতে না পারলেও অন্তত থানা পুলিশকে ঘটনাটি জানাতে পারত। কোনো সংবাদকর্মীর কাছে বিষয়টি জানাতে পারত। অন্তত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করতে পারত। দুঃখজনক হলেও সত্য তেমন কাজ একলাশপুরে কেউ করেনি। বড় অদ্ভুত লাগে মৃতের মতো বেঁচে আছে একলাশপুরের মানুষগুলো।
অন্যদিকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় পুলিশের কাজের পরিধি নিয়ে। শুধু কি থানায় অভিযোগ এলেই তারা তৎপর হবে? এর বাইরে সমাজে কোথাও অন্যায় কিছু হচ্ছে কিনা, মানুষ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কিনা তার খোঁজ নেওয়া কি পুলিশের কাজ নয়? এমন একটি জঘন্য ঘটনার এক মাস পরও কি পুলিশ জানতে পারলো না তা? তাদের সোর্স কি এতই দুর্বল? যে যুবকরা ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা কি এতই ক্ষমতাবান যে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কেউ থাকলো না একলাশপুরে? তারা এতই বেপরোয়া ও উদ্ধত যে ভিডিও ভাইরাল করার সময়ও তারা ভীত হয়নি।
এই যে ভীত না হওয়া এটাই দেশে ধর্ষণের মতো ঘটনা বৃদ্ধির কারণ। এই ধরনের উদ্ধত আচরণ আমরা লক্ষ করি সিলেট এমসি কলেজে সংঘটিত ঘটনার বেলায়ও। ঘটনাদৃষ্টে মনে হয় অপরাধীরা ধরেই নিয়েছে তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না অথবা কয়েকদিন থানা-পুলিশ করলেও শেষ পর্যন্ত তারা যেভাবেই হোক রেহাই পেয়ে যাবে।
পূর্বেই বলেছি, ধর্ষণের ঘটনা মোকাবেলা করা ধর্ষিতা বা তার পরিবারের পক্ষে সত্যিই কঠিন। অনেকেই জানেন সমাজ থেকে আদালত সবখানে ক্ষতিগ্রস্ত নারীকে অহরহ অবমাননাকর পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। প্রথম প্রথম কয়েকদিন মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতার কারণে পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে সহনশীল থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত নারীর পক্ষে তখন কার্যত কেউ থাকে না। আর এ ধরনের মামলায় আসামি বা দোষীদের উপযুক্ত সাজা প্রদানে পুলিশের যে ভূমিকা থাকার কথা তা থাকে না। দোষীদের চাপে বা অর্থের বিনিময়ে পুলিশের চূড়ান্ত রিপোর্টে এমন ফাঁকফোকর রাখা হয় যে আসামি মামলা থেকে অনেক সময় রেহাই পেয়ে যায় নতুবা গুরু পাপে লঘু দণ্ড হয়। অনেক সময় দোষীরা জামিনে বেরিয়ে এসে ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও তার পরিবারকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য করে নতুবা মামলা পরিচালনায় অপারগ করে তোলে। এমন হাজার হাজার ধর্ষণের ঘটনায় শেষ পর্যন্ত দোষীদের প্রকৃত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়েছিল কি না তা দেশবাসীর কাছে অজানা থেকে যায়।
ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের ঘটনা যে বাংলাদেশেই ঘটছে তা কিন্তু নয়। সমপ্রতি আমেরিকায় ‘অ্যাথলেট এ’ নামের একটি ডকুফিল্ম মুক্তি পেয়েছে যেখানে উঠে এসেছে আমেরিকার অ্যাথলেট জগতে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানির করুণ কাহিনী। এর আগে হলিউডের নারী অভিনেত্রীরা তাদের ওপর যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। বলিউডে তোলপাড় চলছে। বাংলাদেশের শোবিজ জগতেরও কেউ কেউ মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তবে সবকিছুই প্রকৃত ঘটনার সামান্য দিক মাত্র। কারণ অধিকাংশ নারী তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোকে ভুলে থাকতে চায় এবং সন্তান, পরিবার ও সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। সব দেশেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে পুরুষকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।
ধর্ষণের ঘটনা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এর মধ্যে আরও বেশি উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো বিষয় হলো ধর্ষণকারীদের ঔদ্ধত্য। এরা ধর্ষণ করেই এখন ক্ষান্ত হচ্ছে না তা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে অর্থাৎ এরা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে ভিডিওটি ভাইরাল হলে তাকে যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করতে পারে কিংবা নিজে ধর্ষক হিসেবে সমাজে নিন্দিত হতে পারে সে ভয়ও তারা করছে না। এটাই এখন বড় আতঙ্কের কারণ। অপরাধী এমন উদ্ধত হয়ে ওঠার পেছনে কারণ কী? সমাজ বা রাষ্ট্র কি পক্ষান্তরে তাদের মনে অভয় তৈরি করেছে? আইন-বিচার তাদের কিছুই করতে পারবে না এমন ধারণা তৈরি হয়েছে তাদের ভেতর? যদি তাই হয় তাহলে রাষ্ট্রের জন্য তা খুবই বিপজ্জনক। এটি সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনায় নেবে না সাধারণ মানুষ?
ধর্ষণের মতো ঘটনা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অনেকে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কেও দায়ী করেন। এ অবক্ষয়ও একদিনে তৈরি হয়নি। এর জন্য বর্তমান ও অতীতের সরকারগুলো কম দায়ী নয়। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা ব্যাহত হলে সেখানে অসুস্থ ও বিকৃত সংস্কৃতিচর্চা বিকাশ লাভ করে। একসময় দেশে বেশ কিছু শিশু সংগঠন ছিল। পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল।বছর ধরে এসব সংগঠনের আয়োজনে পাড়ায় মহল্লায় নারী-পুরুষ-শিশু ধনী-গরীব মধ্যবিত্ত এক সঙ্গে যোগদান করত।ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে একটি সামাজিক বন্ধন তৈরি হতো। শিশু সংগঠনে ছেলে-মেয়ে একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক বলয়ে বেড়ে উঠত।ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের সহমর্মিতাবোধ জাগ্রত হতো। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজেদের মধ্যে একটি সমীহবোধ তৈরি হতো। নারীকে অন্য গ্রহের প্রাণী না ভেবে তারা নিজেদের মা খালা বোন বন্ধু হিসেবে গণ্য করতো। এখন শিশু-কিশোর সংগঠনগুলোর তৎপরতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্র হয়েছে সীমিত।
সমাজ এমন অমানবিক হয়ে ওঠার পেছনে যে কারণগুলো আছে তা কলামের মতো ছোট্ট পরিসরে তুলে আনা সম্ভব নয়। এর জন্য ব্যাপক পরিসরে আলোচনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। তবে সবচেয়ে আগে জরুরি ভিত্তিতে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে ধর্ষণকারীদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা করা। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায় বলে, বিচারে দীর্ঘ কালক্ষেপণ হয় বলে অপরাধীরা যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তা বন্ধ করতে হবে আগে। প্রচলিত আইন বা বিচার ব্যবস্থায় এটা কতটুকু সম্ভব তা আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বক্তিরা ভালো বলতে পারবেন তবে আমরা সাধারণ মানুষ দাবি করি ধর্ষণকারীদের বিচারের জন্য একটি আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের। শুরুতে লিখেছিলাম এরা আসলে মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে কাজেই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের মত আরেকটি ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণকারীদের দ্রুত বিচার করে দেশটাকে সভ্যতা ও মানবতার পথে নিয়ে যেতে হবে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকার জোরে ওরা অনাচারের ভিডিও সামাজিক মিডিয়ায় ছড়ানোর সাহস পায়
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম