রাত প্রায় ১টা যমুনা এক্সপ্রেস লেট ছিল। রাইট টাইম ১২ টা। কথা ছিল স্টেশনে বাড়ির কেউ থাকবে আমি ফোন দিলে কেউ এসে অপেক্ষা করবে। স্টেশনে আসার এক ঘন্টা আগে ফোনের সুইচ অফ হয়ে গেছে। চার্জের কোন ব্যবস্থা নেই। স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে যত দূর চোখ যাচ্ছে আঁধারে ঢাকা। গ্রামের সব বাড়িতে ঘুমের মধ্য রাত চলছে। কান ধরে আসছে ঝিঝি পোকার একটানা আওয়াজে। শিরিষ গাছের ডালে পাখিদের পাখা ঝাপ্টানোর আওয়াজ পেলাম। স্টেশন মাস্টার ভেতর থেকে রুম লক করে নাক ডাকছে। কুলি মজদুর কেউ নেই। কিরে বাবা কেমন যেন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। দূরে নিভু নিভু আলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কিসের আলো? ট্রেন নাকি গার্ড? হঠাৎ ঝুপ করে পায়ের সামনে কি যেন পড়ল চমকে উঠলাম।
কালো মিচমিচে বিড়াল। আমাদের গ্রামের তিন রাস্তার মোড়ে ঠিক স্টেশনের পশ্চিমে বিশাল একটা বটগাছ। প্রায় ২০০ বছরের পুরাতন বিড়ালের চৌদ্দ পুরুষের জন্ম এই গাছে। অনেক রাতে দোকান পাঠ বন্ধ করে যারা এই পথে আসা যাওয়া করে, তাদের পিছে পিছে বিড়াল যায়। ভাল মন্দ বুঝি না ভয়ে কেউ কেউ কালা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চির নিদ্রায় যায়। একবার বাবার ট্রেন লেট ছিল। ট্রেন থেকে নামতেই গা ছমছম করে উঠল। হাঁটতে গিয়ে পা চলে না।
মনে হচ্ছিল পিছনে কেউ আসছে, বাবা ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকাতেই বিড়ালের চোখ জ্বলজ্বল করছিল। সেই রাতেই বাড়ি ফিরেই বিছানগত জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল। কলসের পেট ফুটা করে মাথার উপর বেঁধে দেয়া হয়েছিল। সেই বিড়ালের বংশ একটা আমার পায়ে পড়ল, জ্বর আসবে নির্ঘাত। আলোটা একটু একটু সামনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। না ট্রেনের লাইট না। কৌতূহল বসত ভয়ে ভয়ে বুকে সাহস সঞ্চয় করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শততালির জামা গায়ে রাইস মিয়া।
একসময় এই স্টেশনের কুলিদের সর্দার ছিল আর ট্রেনের লাইন ম্যানের কাজ করত। বয়স প্রায় সাতাশি বছর, মাথায় সমস্যা হয়েছে, সেই কারণে বাড়ির লোকজন বাইরে আসতে দেয় না। কিন্তু উনি পালিয়ে হলেও এই স্টেশনে আসে, তার বাবাও ছিল এই স্টেশনের গার্ড। শৈশব থেকে এই বয়স অবধি তার লম্বা সময় কেটে গেল এখানেই। বাড়ির সবাই যখন গভীর ঘুমে মগ্ন তখন উনি হাতে হ্যারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কাছে এগিয়ে গেলাম,চাচা আপনি এত রাতে কেন? আমি না আসলে ট্রেনের লাইন চেক করবে কে? তার ধারণা সে ছাড়া কেউ নাই।
বহু দিন মাস বছর চলে গেছে তার সামনে দিয়ে কত মানুষ আসছে গেছে,সে পড়ে আছে আগের জায়গায়। তার বয়সের দু একজন আছে হাঁটু মাথা এক করে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, সবুজের মাঝে লাল নীল হলুদ বেগুনী রশ্নি ফুটে উঠেছে। প্লাটফর্ম থেকে নীচে নেমে মনে হলো মাটিতে মায়ের আঁচল পেতে রেখেছে। হাঁটার পথে কত নাম জানা অজানা গাছ। বাবলা গাছের হলুদ ফুল বানিয়ে নিলাম কানের দুল। সোনালু ফুলের মালা বানিয়ে নিলাম গলায়। হাতে পরলাম ঘাসফুল। মা মাটির মমতা আমায় জড়িয়ে নিল বুকে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম মায়ের কোলে। সেই যুগের কালো বিড়ালের বংশ থাকলেও জ্বর আর আক্রমণ করতে পারে নাই।